বিজয় মিছিলে গিয়ে শহীদ হন মতলবের হাফেজ দীন ইসলাম

চাঁদপুর : চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়নের মধ্য ঠেটালিয়া গ্রামের শাহ আলম বেপারীর ছেলে হাফেজ দীন ইসলাম (২২)। বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন ঢাকা যাত্রাবাড়ী ভাড়া বাড়িতে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বিকেলে বিজয় মিছিলে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি। পুলিশ তাকে প্রথমে গুলি করলে দুই হাতের তালুতে লাগে। পরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে শরীরের নীচের অংশে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। তাকে ওই স্থান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতেও বাঁধা দেয় পুলিশ। পরে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন হাফেজ দ্বীন ইসলাম।

সম্প্রতি শহীদ দীন ইসলাম এর গ্রামের বাড়ী মতলব উত্তর উপজেলার মধ্য ঠেটালিয়া গ্রামের বেপারী বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় তার দাদী লতিফা বেগমকে। তিনিই গ্রামে থাকেন।

তিনি বলেন, আমি একই বাড়িতে থাকি। গত কোরবানির ঈদে দীন ইসলাম আমার ছেলে ও বউসহ বাড়িতে এসেছে। ঈদের পর আবার ঢাকায় চলে যায়। আমার নাতি সব সময় আমার খোঁজ খবর নিত। তার বাবা কাজে ব্যস্ত থাকত। সে জন্য আমার যে কোন বিষয়ে নাতি কথা বলত। এখনো শুধু আমার চোখের সামনে নাতির চেহারা ভাসে। কান্না জড়িত কন্ঠে আর বেশি কথা বলতে পারেননি দাদি।

দীন ইসলামের বাড়ীর সম্পর্কে কাকি শাহিনুর বেগম বলেন, ছোট বেলায় দীন ইসলাম স্থানীয় একটি হেফজ মাদ্রাসায় পড়েছে। ওই মাদ্রাসাকে সবাই জসিম হুজুরের মাদ্রাসা বলে। সেখান থেকে পরে তার বাবার সাথে ঢাকা চলে যায়। ঢাকায় চলে যাওয়ার পর যতবারই বাড়িতে এসেছে আমাদের সাথে দেখা হয়েছে এবং কথা হয়েছে। খুবই অমায়িক ব্যবহার ছিলে তার। তার মৃত্যুর পর পুরো গ্রামবাসী শোকাহত। কারণ তার বাবা দুর্ঘটনায় অনেকটা পঙ্গু। বড় ছেলে হিসেবে বাবার সহযোগিতা করার মত আর কেউ রইলনা।
স্বজনদের সাথে কথা বলে জানাগেল, মধ্য ঠেটালিয়া বেপারী বাড়ীর মৃত ইদ্রিস বেপারীর ছেলে শাহ আলম বেপারী শহীদ দীন ইসলামের বাবা। তিনি এক সময় এলাকায় ছিলেন। পরে তার চাচা গিয়াস উদ্দিনের মতিঝিলের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এরপর নিজেই যাত্রাবাড়ী এলাকায় আখের রস বিক্রি করতেন। আখের রসের মেশিনের সাথে পেচিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। তিনি তার শরীরের বাম পাশ অনেকটা পঙ্গুর মত হয়ে যায়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় চিকিৎসা নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার মসজিদের পাশেই চায়ের দোকান দিয়ে জীবন জীবীকা নির্বাহ করতেন।

শাহ আলম দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়া বাড়িতে থাকতেন যাত্রাবাড়ী শহীদ জিয়া কলেজ সড়কের মুন্সীর বাড়ীতে। বড় ছেলে শহীদ হাফেজ দীন ইসলাম। ছোট ছেলে সামিউল বেপারী শনির আখড়া কলেজে এইচএসসিতে পড়ে। স্ত্রী শিল্পী বেগম গৃহিনী। শাহ আলমের বর্তমানে যাত্রাবাড়ী থানার মসজিদের পাশে ফুটপাতে চা বিক্রি করেন।

শহীদ দীন ইসলামের মৃত্যুর বর্ননা দেন পিতা শাহ আলম। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে দুই ছেলেসহ দোকানের সামনে রাস্তায় এক লোকের সাথে কথা বলছিলাম। ওই সময় চারদিকে সংঘর্ষ আর গোলাগুলি। কথার মধ্যেই দুই ছেলে আমার সামনে থেকে চলে যায়। বড় ছেলে থানার সামনে গেলে পুলিশ গুলি করে। প্রথমে তার দুই হাতে গুলি লাগে। গুলিতে বাম হাতের কিছু অংশ চলে যায়। এরপর সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তার শরীরের নীচের অংশে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। ৩টার দিকে আমি এই ঘটনা জানতে পেরে সেখান থেকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশের বাঁধায় আর চিকিৎসার জন্য নিতে পারিনি। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

শাহ আলম বলেন, সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীতে তার প্রথম নামাজে জানাজা হয়। পরবর্তীতে গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে রাত ১২টায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো। গ্রামের মাদ্রাসায় এক বছর পড়ার পরে এখানে নিয়ে আসি। যাতাবাড়ী কুতুবখানা বড় মাদ্রাসায় দিলে সেখান থেকে হিফজ শেষ করে। গত দুই বছর কোন মাদ্রাসায় ভর্তি করাইনি। আমার সাথেই সহযোগিতা করত। কারণ আমি বেশি সময় অসুস্থ থাকি। তবে চিন্তা ছিলে খুব তাড়াতাড়ি তাকে কিতাব পড়ার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করাব। সেই স্বপ্ন আর পুরন হলোনা।
শাহ আলম বলেন, আমার ছেলে শহীদ হওয়ার পর আমার পরিবার খুবই হতাশাগ্রস্ত। ছেলের কথা মনে পড়লে কোন কাজই ভাললাগে না। তার মা সারাদিন কান্না করে।

দীন ইসলামের ছোট ভাই সামিউল বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আমাদের দোকান বন্ধ ছিলো। বাবার সাথেই ছিলাম আমরা দুই ভাই। পরে লোকজন আনন্দ মিছিল শুরু করলে সেখানে যাই। থানার সামনে গেলে বড় ভাই গুলি খায়। আমি সেখান থেকে দৌড়ে মাছ বাজারে চলে যাই। কিন্তু ভাই দৌড় যেতে পারে নাই। পুলিশ গুলি করলে মাটিতে পড়ে যায়।

দীন ইসলামের মা শিল্পী বেগম বলেন, আমার ছেলে কি অন্যায় করেছে। তাকে কেন পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হলো। পুলিশ প্রথমে গুলি করে হাতে। ছেলে আমার প্রাণে বাঁচার জন্য দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু নিষ্ঠুর পুলিশ তাকে বাঁচতে দেয়নি। শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আমি বেঁচে থাকতে এই গুলির নির্দেশদাতা ও তার পুলিশ বাহিনীর বিচার দেখে যেতে চাই। কারণ আমার বড় এই ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু পুলিশ আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

ফম/এমএমএ/

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | ফোকাস মোহনা.কম