।। এস ডি সুব্রত।। মানবজীবনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম । পরিবার শুধুমাত্র মানব শিশুর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় পশু প্রাণীর জন্য পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।একটি মানব শিশুর জন্মের পর তার সামাজিকীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিবার। পরিবার হতেই একটি শিশু সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শিক্ষা লাভ করে। একটি শিশুর হাতে খড়ি পরিবার হতেই শুরু হয়। প্রতিবছর সারা বিশ্বে ১৫ মে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়ে থাকে। পরিবারের গুরুত্ব কথা বিবেচনা করে এই দিবসটি পালনে সূচনা হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা, ও ভালোবাসার বন্ধন এর মাধ্যমে পরিবারে একজন মানুষ সমাজে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। মানুষ সামাজিক তথা জীব । সামাজিক উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পরিবার। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের প্রত্যেকেরই একটি পরিবার আছে । পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা এবং পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বিশ্বব্যাপী পালিত হয় “বিশ্ব পরিবার দিবস “ । সাধারণত পিতামাতা, ভাইবোন সন্তান-সন্ততি নিয়ে গঠিত হয় পরিবার। আমাদের সমাজে যৌথ ও একক পরিবার প্রচলিত রয়েছে । পরিবারকে বলা হয় পরস্পরের কল্যাণ কামনাপূর্ণ নৈতিক বন্ধুত্ব । মায়ের স্নেহ ,পিতার আদর , ভাইবোনের মমতা আর প্রতিবেশীর সথে সম্পর্কের অমোঘ বন্ধন পরিবেশেই জন্ম দিতে পারে মানুষের ভবিষ্যৎ সুস্থ সুন্দর সমাজ। পরিবার হচ্ছে মানুষের প্রথম শিক্ষালয় । পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে পরিবারে একজন মানুষ সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সংস্কৃতিতে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারকে বলা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা ও দায়িত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারই একজন মানুষের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ।
রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু নিয়মনীতি আছে তেমনি পরিবারেরও নিয়মনীতি রয়েছে। যেমন, পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যা না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা প্রভৃতি। মানবজীবনে প্রত্যেক মানুষের জন্য এই পারিবারিক শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলো আয়ত্ত করতে পরিবার-ই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। নানাবিধ চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ শেখা,বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন,কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা,অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা,পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা,উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না অর্জন করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবার থেকে অর্জন করা যায়।
আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থার প্রসার, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সংখ্যানুপাতিক হারে জীবিকার তারতম্য ঘটতে থাকায় যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের সমাজ বিজ্ঞানী নজরুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, জীবনের তাগিদেই আগের মতো ভাই-ভাই এক সঙ্গে বসবাস করেন না। এমনকি এই ঢাকা শহরে একই বিল্ডিংয়ে পাশাপাশি ফ্লাটে থাকলেও কথা বা সামাজিক রীতির আদান প্রদান হয় খুবই কম। কোন মানুষ পরিবারে একটু বড় হলে কিংবা বিয়ে করার পর সন্তান হলেই তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে যৌথপরিবার থেকে আলাদা হয়ে নতুন একটি ছোট্ট পরিবারের জন্ম দিচ্ছেন প্রায় সবাই। তার অনুযোগ, যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার কুফল হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশে যা উদ্বেগজনক।
১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় শিল্প বিপ্লব ঘটতে থাকে। শিল্প প্রসারের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর যুব সমাজ অর্থ উপার্জনে ঝুঁকে পড়েন। এতে পরিবারের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যায়। অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। কাজ এবং অর্থের প্রয়োজনে যে যেখানে পারছে ছোট ছোট পরিবার গড়ে তুলেছে। এভাবেই ভেঙে গেছে অনেক যৌথ পরিবার।
১৯৮০ এর দশকে, জাতিসংঘ পরিবার সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে মনোনিবেশ করা শুরু করে। ১৯৮৩ সালে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের সুপারিশগুলির ভিত্তিতে, উন্নয়ন প্রক্রিয়াতে পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে সামাজিক উন্নয়ন কমিশন (১৯৮৩/২৩) সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে মহাসচিবকে অনুরোধ করে এবং পরিবারের সমস্যা এবং কার্যকরী পন্থায় পরিবারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
১৯৮৫ সালের ২৯ শে মে, ১৯৮৫/২৯ এর রেজুলেশনে কাউন্সিল জেনারেল অ্যাসেমব্লিকে তার চল্লিশতম অধিবেশনের অস্থায়ী কর্মসূচিতে “উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবার” নামে একটি আইটেম অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা বিবেচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সরকার, আন্তঃসরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলো এবং জনমত নির্বাহের দিকে জড়িত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশ্ব সচেতনতার বিকাশের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য মহাসচিবকে অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে, সামাজিক উন্নয়ন কমিশনের ৩০তম অধিবেশন অধিবেশন গঠনের সুপারিশের ভিত্তিতে এই সংসদটি সমস্ত রাজ্যকে পরিবারের একটি আন্তর্জাতিক বছরের সম্ভাব্য ঘোষণার বিষয়ে তাদের মতামত জানাতে এবং তাদের মতামত ও প্রস্তাব দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
পরিষদ সেক্রেটারি-জেনারেলকে তার ৩০তম তৃতীয় অধিবেশনে সাধারণ পরিষদকে এমন একটি বছরের সম্ভাব্য ঘোষণার বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মতামত এবং প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে এবং পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য অন্যান্য উপায় ও উপায়ের ভিত্তিতে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন দাখিলের অনুরোধ জানায় এবং পরিবারের মঙ্গল এবং সামাজিক অগ্রগতি এবং বিকাশের বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার। ১৯৮৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর ৪৪/৮২ এর রেজুলেশনে, সাধারণ পরিষদ ১৯৮৯ সালে এক প্রস্তাবে ১৯৯৩ সালকে বিশ্ব পরিবার বর্ষ হিসেবে অনুমোদন করে এবং ১৫ মে’কে বিশ্ব পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার সমাজের ভিত্তিমূল। হিন্দু ধর্ম মতে, পরিবার হচ্ছে একটি মন্দিরের মতো, যেখানে দেবতা স্বরূপ বাবা-মা বাস করে। আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসে বিশ্বের প্রতিটি পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হোক এবং সুখ শান্তিতে ভরে উঠুক প্রতিটি পরিবার ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
নিলয় ১৪, নতুন পাড়া, সুনামগঞ্জ।
০১৭৭২৪৮২২৪
sdsubrata2022@gmail.com