আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধু

ছবি: লেখক এস ডি সুব্রত।
।। এস ডি সুব্রত।। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাঙালি জাতিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে দীর্ঘ ৯ মাস। দেশের সব শ্রেণি-পেশার লোক জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তান বাহিনীর হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আজকের বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা অর্জনে দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশি কিছু বন্ধু তাদের অকৃত্রিম সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন । নয় লক্ষ শহীদ ,দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেয়েছিলাম কাংখিত স্বাধীনতা আমাদের
মুক্তিযুদ্ধে দেশের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ এগিয়ে এসেছিলেন কিছু বিদেশী বন্ধু । পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী কর্তৃক  নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা, নির্যাতন এবং একপেশে যুদ্ধের খবর বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে কিছু বিদেশী বন্ধু এগিয়ে এসেছিল তখন । কেউ কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে,কেউ কবিতার মাধ্যমে ,কেউ গানের মাধ্যমে  বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলেন  এ যুদ্ধের খবর । শুধু জানান দেননি , অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাও করেছিল কিছু অকৃত্রিম বিদেশি বন্ধু।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের মানুষকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। এমন কী তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমর্থন আদায়ের জন্যও কাজ করছেন। ভারতের বিখ্যাত সেতার বাদক পন্ডিত রবিশঙ্কর ও তার বন্ধু বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য  জর্জ হ্যারিসন এর নাম সবার আগে আসে । তাদের আয়োজনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকেই বিশ্ববাসীকে  প্রথম আবেগী নাড়া দেয়।১ আগস্ট ১৯৭১ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে বসল পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় এক ঐতিহাসিক কনসার্ট। সেখানেই বাংলাদেশের জন্য বাজালেন সেতারসম্রাট রবিশঙ্কর, সরোদসম্রাট ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, তবলার কিংবদন্তি শিল্পী আল্লারাখা খাঁ। তারপর একে একে গান গাইলেন বিটলসের জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রিস্টন আর কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলান। কিংবদন্তি গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাটনও গিটার বাজিয়েছিলেন কনসার্টটিতে। জর্জ হ্যারিসনের  গাওয়া  বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ’  আজো নাড়া দেয় মানুষের মনকে ।ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার  ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। অপারেশন সার্চলাইটের সময় তিনি লুকিয়ে সে রাতের ভয়াবহতার কিছু ছবি তুলে পাঠান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তিনি ছিলেন একজন ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান কমান্ডো অফিসার।এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আর নিরীহ মানুষকে হত্যার বিরুদ্ধে নিজের মানবিক তাড়নাতেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে লড়তে থাকেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। আগস্ট মাসের দিকে তিনি টঙ্গীতে বাটা কোম্পানির ভিতরে গেরিলা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য-ওষুধ এবং আশ্রয় দিয়েও তিনি সাহায্য করেছিলেন। টঙ্গী ও এর আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল গেরিলা হামলার আয়োজকও ছিলেন তিনি। নিজের জীবন বাজি রেখে  কলম আর ক্যামেরা হাতে নিরীহ বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন  ইংরেজ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। তিনি তখন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের একজন সাংবাদিক। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তিনি তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে।
এক সময় সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেলে তিনি দেশত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
তিনি ২৭ তারিখে পকিস্তানি বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে ঢাকার বুকে  হত্যা, ধ্বংস আর লুটপাটের পর্যাপ্ত ছবি নিয়ে তিনি পালিয়ে চলে গেলেন ব্যাংককে। আর সেখান থেকে প্রকাশ করলেন ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। বিশ্ববাসীর সামনে তিনি তুলে ধরলেন নির্মম বাস্তবতাকে। তার পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে সারা দুনিয়া।
বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের জন্য   এগিয়ে এসেছিলেন ।এদের একজন  বাংলাদেশিদের অকৃত্রিম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি  ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে কেনেডি সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছিলেন ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’। এ রিপোর্টে কেনেডি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।পল কনেট দম্পতি প মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাংলাদেশের খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধপথ্য পাঠানোর জন্য তিনি ‘অপারেশন ওমেগা’ নামে একটি সংস্থা করেন। লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় তারা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি কার্যালয় খোলেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনমত গঠন করতে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিশাল জনসভার আয়োজন করেন তারা। কবি এলেন  গিন্সবার্গ। তিনি একজন মার্কিন কবি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি লিখেছিলেন একটি দীর্ঘ কবিতা যেটির  নাম ছিল- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার কবিতাটি ছুঁয়ে যায় হাজারও মানুষের হৃদয়। তার কবিতা শুনে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন হাজারো মানুষ। তার কবিতাটির কয়েকটি লাইন — ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রে সান, আ মিলিয়ন আর ডেড, দ্য মিলিয়নস হু ক্যান, ওয়াক টুওয়ার্ড ক্যালকাটা ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’। কবিতার ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানই হলো বর্তমান বাংলাদেশ।
মার্ক টালি তৎকালীন সময়ে কর্মরত ছিলেন বিবিসিতে। যুদ্ধকালীন রেডিও হাতে সময়ে সকাল-সন্ধ্যা দেশবাসী অপেক্ষা করত মার্ক টালির কথা শোনার জন্য। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার বাস্তব চিত্র বিশ^বাসীর সামনে তুলে ধরেন    বিবিসি সাংবাদিক মার্ক টালি। তার খবরের মাধ্যমে সারা পৃথিবী বুঝতে সক্ষম হয় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্র। ১৯৭১ সালে  এসব বিদেশী  বন্ধুদের অবদানের কথা শ্রদ্ধা র সাথে স্মরণ করবে বাঙালি জাতি।
লেখক :  কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম