শহীদ সাজ্জাদকে হারিয়ে পরিবার এখনো জিন্দালাশ

শহীদ হাফেজ সাজ্জাদ সাব্বির। ছবি: সংগ্রহীত।

চাঁদপুর: গেল বছর ১৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর মিরপুর ১০নম্বর গোল চত্বর এলাকায় মসজিদে আসর নামাজ আদায় করে মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন হাফেজ সাজ্জাদ হোসেন সাব্বির (১৯)। তিনি চাঁদপুর শহরের রঘুনাথপুর গ্রামের রাজা বাড়ির জসিম উদ্দিন রাজার ছেলে।

ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর মা শাহনাজ বেগম। তিনি কান্না জড়ি কন্ঠে বলেন ‘পুলিশ যেন পরিবারের একজনকে না, বরং সকলকে গুলি করে হত্যা করে। কারণ ছেলেকে হারিয়ে আমাদের পরিবার এখনো জিন্দালাশ।’

সম্প্রতি শহীদ সাব্বিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পুরো বাড়িতেই নিরবতা। ছেলে কুরআনের হাফেজ হওয়ার কারণে পরিবারটি ধার্মিক। প্রথমে ছেলে শহীদ হওয়ার বর্ননার কথা বলতে রাজি হননি সাব্বিরের মা। অনেক অনুরোধের পরে এই প্রতিবেদককে ছেলের ছোট থেকে বড় হওয়ার স্বপ্নের কথা জানান তিনি।

স্বজনদের সাথে আলাপ করে জানাগেল, শহীদ হফেজ সাব্বির এর বাবা মো. জসিম উদ্দিন রাজা পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। নিজ এলাকায় বিভিন্ন স্থানে কাজ করে সংসারের খরচ বহন করেন। মা শাহনাজ বেগম গৃহীন। সাব্বির বড়। তার ছোট ভাই ৮ বছর বসয়ী সাফায়েত হোসেন (সামি) স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়েন।

সাব্বিরের বাবা জসিম উদ্দিন জানান, আমার দুই ছেলে। সাব্বিরকে মাদ্রাসায় পড়ানোর স্বপ্ন আমাদের। যে কারণে ছোট বেলায় স্থানীয় মাদ্রাসায় ভর্তি করাই। এরপর হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা ফুলছোঁয়া মাদ্রাসার হিফজ খানায় ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে সে কোরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর একই মাদ্রাসায় মিজান শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে।

তিনি জানান, ছেলে মাওলানা হবে এটা ছিলো আমাদের স্বপ্ন। কিন্তু সাংসারিক অভাব অনটন দেখে ছেলে আমার পড়া শেষ হওয়ার আগেই ঢাকা মিরপুর ইউসুফ খান নামে ব্যাক্তির ‘ঢাকা মটরস’ নামে প্রতিষ্ঠানে কাজ শিখতে যায়। সংসারের হাল ধরার আগেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলেগেল। ছেলেকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। আমার পরিবারের মত অনেক পরিবার সন্তান হারা হয়েছে। আমি এই বিচার আল্লাহর কাছে চাইব।

সাব্বিরের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু সম্পর্কে ফুফাত ভাই জিল্লুর রহমান সিফতা। তিনি চাঁদপুর কারিগরি বিদ্যালয় ও কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

সিফাত বলেন, ছোট বেলা থেকেই সাব্বির আমার সাথে চলফেরা করতো। পুরো শৈশবে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। গেল বছর ঈদুল ফিতরের পরে বন্ধুদের নিয়ে আমরা বান্দরবান ভ্রমনে গিয়েছি। সেখানে আমাদের সাথে সাব্বিরও ছিলো। পরবর্তী ভ্রমনে আমরা কক্সবাজার যাব এমন পরিকল্পনা ছিলো। সাব্বির শহীদ হওয়ার পরে আমাদের সকল বন্ধু শোকাহত।

সিফাত আরও বলেন, গেল বছর ১৭ জুলাই আমার সাথে সব শেষ কথা হয় সাব্বিরের। আমাদের বন্ধুদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছিলো। ওই গ্রুপেই কথা হয় তার সাথে। আমি সাব্বিরের কাছে জানতে চাই কি অবস্থা ঢাকায়। সে পরিস্থিতি জানায়। তাকে কয়েকবার নিষেধ করেছি তুমি আন্দোলনে যাবে না। কিন্তু সে আমাদের কথা শুনেনি। ঘটনার দিন বিকেলে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়।

শহীদ সাব্বিরের মা শাহনাজ বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে আল্লাহ ভালই রেখেছিলো। আমার স্বামী মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যে কারণে ছেলে পড়া অবস্থায় কাজে যোগদেন। আমার বড় ভাই জাহাঙ্গীর ঢাকায় থাকেন। তিনিই সাব্বিরকে ওয়ার্কসপের কাজে নিয়ে দেয়। আমাদের স্বপ্ন ছিলো ছেলে আলেম হবে এবং ইসলামের খেদমত করবে। সেটি আর হলো না।

তিনি বলেন, ১৯ জুলাই কর্মস্থল এলাকায় মসজিদে আসরের নামাজ পড়েন আমার ছেলে। এরপর মিরপুর গোল চত্বর এলাকায় ছাত্র-আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন। সেখান থেকে অন্য ছাত্ররা তাকে প্রথমে হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ পরে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমার ভাই জাহাঙ্গীর ছেলে গুলিতে আহত এবং পরে মারা যাওয়ার সংবাদ দেয়। ওই রাতেই ভাই লোকজনের সহযোগিতায় ছেলের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন ২০ জুলাই বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

সাব্বিরের মা আক্ষেপ করে বলেন, আল্লাহর সিদ্ধান্তই হচ্ছে বড় সিদ্ধান্ত। কিন্তু ছেলে হারা শোক মা হিসেবে কিভাবে মেনে নেই। কারণ আমার ছোট ছেলে জিজ্ঞাসা করে মা ভাইয়া কবে বাড়িতে আসবে। অবুঝ শিশুকে আমি জবাব দিতে পারি না। পুলিশ বাহিনীকে উদ্দেশ্যে করে এই শহীদের মা বলেন, পুলিশ গুলি করার সময় একজনকে নয়, যেন পুরো পরিবারকে গুলি করে মারে। কারণ আমার ঘর ও পরিবারের সদস্যরা এখন জিন্দালাশ। কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারি না। শুধুই আমার আদরের সন্তানের চেহারা সামনে আসে।

শহীদ সাজ্জাদের বাবা জসিম রাজা জানান, চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট আমাদের সাথে থেকে দেখা করেছেন। আর রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামাত ইসলামের নেতারা সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগন আমাদের সাথে দেখা করে সহমর্মিতা জানিয়েছেন।

এর মধ্যে প্রশাসনের কর্মকর্তাগন যাওয়ার সময় বিভিন্ন আইটেমের ফল নিয়ে যান এবং ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেন এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই লাখ, জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫লাখ টাকা, সর্বশেষ জুলাই ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থেকে ১০লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি।
ফম/এমএমএ/

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | ফোকাস মোহনা.কম