লালন ফকিরের পরিচিতি ও ধর্ম পরিচয় 

এস ডি সুব্রত।। ” এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে ।
যেদিন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে   ।”(  –লালন  ফকির )
লালন ফকির, লালন সাঁই, লালন শাহ  , মহাত্মা লালন ইত্যাদি  বিভিন্ন নামে  লালন আমাদের কাছে  পরিচিত। কারো মতে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, কারো মতে মানবতার অন্তরালে সর্বেশ্বরবাদী সুফি সাধক, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক । লালন অসংখ্য অসাধারণ গানের শ্রষ্ঠা, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের  অগ্রদূত বলা যায়। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাকে বাউল গানের সম্রাট হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।  লালন ১৭৭২ সালে মতান্তরে ১৭৭৪ সালে নাটরের রানী ভবানির রাজ্যে কোথাও জন্মগ্রহণ করে ছিলেন  । এবং ১৮৯০ সালে তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমায়, কুমারখালীর ছেউড়িয়া গ্রামে  নিজ প্রতিষ্ঠিত আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর জন্মস্থান ও  ধর্ম পরিচয় নিয়ে আজও ঐক্যমত্য পৌঁছানো সম্ভব হয় নি । কারণ লালন কোন না কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঘরে জন্ম নিলেও কোন রহস্যজনক কারণে, অথবা তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শগত কারণে নিজেকে কোন ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচয় দেওয়া, তাঁর কাছে সমীচীন মনে হয়নি। তাই হয়ত তিনি তাঁর জন্মগত ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পনের দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হিতকারী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলতেন না। শিষ্যরা তাঁর নিষেধ ক্রমে বা অজ্ঞানতা বশত কিছুই বলিতে পারেন না”। কারো মতে লালন শাহ বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান কুমারখালী উপজেলা তখন ছিল একটি ইউনিয়ন । লালন গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা ভাড়ারা গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে জন্মাহন করেন। তাঁরা বাবার নাম ছিল শ্রী মাধব কর আর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতি পরাবতী বালন ‌ । লালন  তাঁর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল। শৈশবেই লালন তাঁর বাবাকে হারান। মায়ের আদর স্নেহে লালন বড় হয়ে উঠেন। পরিবারের প্রধান বাবা জীবিত না থাকায় পরিবারের দায় দায়িত্ব পালনের উপর বর্তায় । লালন তাঁর মায়ের সেবার জন্য অল্প বয়সেই বিয়ে করেন ।  পার্শ্ববর্তী আত্মীয় স্বজনদের সাথে বনিবনা না হওয়ার কারণে মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে একই  গ্রামে দাস পাড়ায় নতুন বসতি স্থাপন করেন। লালন সংসার চালাতে গিয়ে লেখাপড়া করতে না পারলেও শৈশব থেকেই তাঁর গান বাজনার সাথে সম্পর্ক ছিল  ।  লালন ছিলেন কারও মতে একজন মানবতাবাদী, যিনি ধর্ম বর্ণ গোত্র সকল প্রকার ধর্মের নামে জাতি-বিভেদ থেকে সরে এসে মানুষ, মানবতার অন্তরালে সনাতন ধর্মের অখণ্ডবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, মোক্ষবাদ, ও সর্বেশ্বরবাদী, অর্থবাদী সুফিবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে ছিল। তাঁর গান ও দর্শন যুগে যুগে আকৃষ্ট করেছে বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, ও বিজ্ঞ জনের। গান্ধীজীরও ২৫ বছর পূর্বে লালনকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল । লালন পুণ্য লাভের তরে  যৌবনের শুরুতে ভাড়ারা গ্রামের দাস পাড়ার প্রতিবেশী বাউল দাসসহ অন্যান্য কয়েকজনের  সাথে  মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে যান। সে সময় রাস্তা ঘাট ও যানবাহন ব্যবস্থা কোন ভাল  ব্যবস্থা ছিল না।  পায়ে হেঁটে বহরমপুর যায় এবং বাড়ির পথে রওনা হতে হয় পায়ে হেঁটে ।  বাড়ি ফেরার পথে লালন হঠাৎ গুটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত এবং  লালন এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পরে । সঙ্গীরা তাকে মৃত ভেবে ও রোগ সংক্রমণের ভয়ে তাড়াতাড়ি মুখাগ্নি করে কোন ব্যবস্থায়/ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দেন । সঙ্গীরা বাড়ি ফিরে লালন গুটি বসন্ত রোগে মারা গেছে বলে তাঁর বাড়িতে জানায়। এ খবরে তাঁরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও, ভাগ্যের লিখন  ভেবে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে।   লালন নদীর জলে ভাসতে ভাসতে কালী গঙ্গা নদীর ছেউড়িয়া প্রান্তে বা ঘাটে বেঁধে থাকে। ছেউড়িয়ার মওলানা (হাফেজ) মলম এর স্ত্রী পানি আনতে গিয়ে তাঁকে অর্ধ  জলমগ্ন অবস্থায় পানিতে ভেসে থাকতে দেখে ও ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যামান দেখতে পায়। ছেলেটি বেঁচে আছে দেখে বাড়িতে এনে, মাওলানা মলম এবং তাঁর স্ত্রী মতিজান নিজের ছেলের মত সেবা দিয়ে অচেনা যুবককে সুস্থ করে তোলেন । সুস্থ হলে মতিজান জিজ্ঞেস করলে  যুবক বলেন  তার  নাম ফকির লালন। রোগে লালনের এক চোখ নষ্ট হয়ে যায়, মুখমন্ডলে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। লালন সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে গেলে, তাঁর মা এবং স্ত্রী খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। সাথে ভগবানের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানায়। খবর পেয়ে গ্রামের সবাই লালন কে দেখতে আসে। লালন কি ভাবে বাঁচলেন, কাদের সেবায় বেঁচে ফিরলেন তাও চারিদিকে প্রচার হয়। এ খবরে সনাতন ধর্মের সমাজ পতিরা এসে আইন বাতলান যে লালন চবনের (মুসলমান) বাড়ি ভাত খেয়েছে তাঁকে আমরা হিন্দু সমাজ গ্রহণ করতে পারিনা। লালনের মা ও স্ত্রী গ্রহণ করতে চাইলেও সমাজ পতিদের কারণে একরাশ  বেদনা বুকে চেপে   লালন ফকিরকে বাড়ি ছাড়তে  হয়েছিল সেদিন স্ত্রী ও মাকে ফেলে । এই কষ্ট  সইতে না পেরে কিছু দিনের মধ্য স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং তাঁর  অসহায় মা ভাড়ারা গ্রামের বৈরাগী কুম্ভু মিত্রের আখরায় আশ্রয় নেন এবং জীবনের বাঁকী সময় এখানে কাটিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
যে ধর্মের অজুহাতে সমাজ পতিরা তাঁকে সমাজচ্যুত করে,  লালন বড়ই মর্ম বেদনা নিয়ে সেই ধর্মের বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে থাকেন। মূলত এখান থেকেই লালনের ভাবনা ও  দর্শনের বিকাশ ঘটে বলে  মনে করা হয় । সেই সময়ে  লালন শাহের সিরাজ সাইয়ের সাথে পরিচয় হয় সিরাজ সাই ছিলেন কাহার সম্প্রদায়ের একজন সাধক পুরুষ। এ সাধকের সান্নিধ্যে এসেই লালন দিনে দিনে হয়ে উঠেন আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনার প্রধান পুরুষ। সিরাজ সাইকে গুরু  হিসেবে গ্রহণ করে ও তাঁর শিক্ষার লালন হয়ে উঠেন ফকির লালন সাঁই। প্রথম দিকে লালন ছেউড়িয়া গ্রামের কালী গাঙের পারে গহীন বনের মধ্য একটি আম গাছের নিচে বসে ধ্যান মগ্ন থাকতেন। ধ্যান মগ্ন কালে লালন জঙ্গল থেকে বের হতেন না । দলে দলে লোকজন তার শিষ্য হতে থাকে । কারিগর সম্প্রদায়েরর  কিছু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।  লালনের সম্মতি নিয়ে  কারিগর সম্প্রদায় লালনের জন্য আখড়া বাড়ি তৈরী করে দেন যাতে বসে লালন আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন। কথিত আছে রোগ মুক্তির কিছু দিন পর লালন বিদায় চেয়ে বলে, “আমি সংসার ত্যাগী মানুষ, এই ভব সংসারে আমার ঠাই নাই”, বলে চলে যেতে থাকেন এবং অলৌকিক ভাবে পায়ে হেঁটে কালী গঙ্গা নদী পার হয়ে যায়। পরে মাওলানা মলম ডিঙি  নৌকায় পাড় হয়ে, দৌঁড়ে গিয়ে লালন কে ধরে ফেলে এবং  লালন ফকিরকে তাঁর বাড়িতে ফিরে যেতে অনুরোধ করে। লালন ফকির কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা থাকার জায়গা ব্যবস্থা করতে হবে। নিঃসন্তান মলম শাহ তাঁর কথা রাখবে বলে জানালে, লালন ফকির ফিরে আসে। কালি গঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমণ্ডিত মাওলানা মলম এর বাগানে তৈরী করে দেয়া হয় চৌচালা ঘড়, আখড়া বাড়ি । লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও বিশেষ কিছু লক্ষ্য করে মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা নেন ফলে মলম কারিকর হয়ে যান মলম শাহ আর মতিজান হয়ে যান মতিজান ফকিরানী । মলমের অপর দুই ভাই কলম ও তিলম স্বস্ত্রীক পর্যায়ক্রমে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ছেঁউড়িয়া কয়েক বছর থাকার পর লালন শিষ্যদের ডেকে বলেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, তোমরা আমার সাধন ঘর দেখা শোনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্প বয়স্কা সুশ্রী  মেয়ে নিয়ে ফেরেন। মতিজান   মেয়েটা কে বাবা জানতে চাইলে  লালন বলে তোমাদের গুরু মা । এ কথা শোনার পর আখড়া বাড়ির সকলেই গুরু  মা কে ভক্তি করে। বিশাখা নামের এই মেয়েটি আমৃত্যু লালনের সঙ্গে ছিল । লালনের সর্বেশ্বরী অখন্ডবাদী, সুফিবাদ ও সনাতন ধর্মের বৈরাগ্যবাদ, বা গৌড়ীয় বৈরাগ্যবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, অর্ধবাদ, অদ্বৈতবাদ, মোক্ষবাদ দর্শন তার মৌলিক দীক্ষা ছেউড়িয়াতে উদ্ধার হাওয়ার পূর্বেই পেয়েছিল।  লালনের দেহ তত্ত্ব, ফকির তত্ত্ব, গুরু তত্ত্ব, তথা সর্বেশ্বর মতবাদের মূল উৎস হলো শ্রীকৃষ্ণ, রাধা, ভগবত গীতা ও পুরাণ থেকে উৎসারিত, শ্রী চৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ এবং পারস্য থেকে উদগত, ভারত বর্ষে এসে সর্বেশ্বরবাদ, অখন্ডবাদের সাথে সমন্বয়কৃত, সুসংগঠিত সর্বেশ্বরী সুফি মতবাদ সাদৃশ্য  ।
লেখক:  কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম