চাঁদপুর : ‘ভূমি অফিস’ এমন একটি সরকারি দপ্তর, যার নাম শুনলে বা সেখানে যাওয়ার কথা মনে আসলেই সাধারণ মানুষের মনে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ দপ্তরগুলোতে দেখা মিলে না সাধারণ মানুষের বসার মত স্থান। অনেকসময় মিলে না সঠিক সেবা। মনোরম বা নান্দনিক পরিবেশের মাঝে ভূমি সেবা পাওয়াতো অনেক বড় ব্যাপার।
এছাড়াও ছোটখাটো বেশ কিছু সমস্যাতো রয়েছেই। তবে এর উল্টো চিত্র চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা ভূমি অফিস। যেখানে নান্দনিক পরিবেশে সাধারণ জনগণ ভূমি সেবা পেয়ে অনেক খুশি।
সরেজমিনে শাহরাস্তি উপজেলা ভূমি অফিসে এমন চিত্রগুলোই প্রতিবেদকের সামনে আসে।
উপজেলা ভূমি অফিসে ডুকতেই চোখে পরবে রং বেরঙের গোলাপ, জবা গাদাসহ নানাধরণের ফুলের বাগান। সেবাপ্রত্যাশীদের বসার জন্যে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বসার স্থান। রয়েছে ফলজ ও ভেষজ বৃক্ষের বাগান। যেখানে অর্জুন, মেহগনিসহ নানাধরণের ফলমূলের গাছ রয়েছে।
সবচাইতে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ভূমি অফিসের ভিতরেই পরিত্যক্ত এবং আবর্জনাময় জায়গাতে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ১৯ জাতের সবজি বাগান। রীতিমতো সেখানে চাষ করে সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। আবার সেই সবজি অফিসের স্টাফসহ আশেপাশের অসহায়রাও পেয়ে থাকে। আর এরই মাঝে সবজি চাষের জায়গাটার ঠিক মাঝখানেই তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা (ঝর্না)। যেখানে সেবাপ্রত্যাশীরা সেবা নিতে এসে সেখানে তারা পরিবারদের নিয়ে বিনোদনের স্বাদও মিটিয়ে যাচ্ছেন। আর উপজেলা ভূমি অফিসটিকে এমন নান্দনিক পরিবেশের রূপ দিয়েছেন শাহরাস্তি উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) রেজওয়ানা চৌধুরী।
জানা যায় গত ২০২৩ সালের ২ মে তিনি এই উপজেলায় যোগদানের পর থেকেই এখন পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও উপজেলার সম্মেলন কক্ষ থেকে শুরু করে রেকর্ড রুমের কাজ করেছেন। বর্তমানে এ উপজেলায় প্রায় ১৮শ’ স্কায়রফিটের একটি রেকর্ডরুম তৈরি করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রেকর্ডরুম। যেখানে খুব সহজেই ২০বছর আগেরও রেকর্ড সংক্রান্ত সবকিছু পাওয়া যায়।
এছাড়া এসিল্যান্ড রেজওয়ানা চৌধুরীর প্রচেষ্টায় আশেপাশে মহিলাদের নামাজের স্থান না থাকায় পরিত্যক্ত একটি রুমের মধ্যে মহিলাদের নামাজের স্থানও করা হয়েছে। যেখানে তিনিসহ অন্যান্যদের নারীরাও নামাজ আদায় করতে পারেন। এমনকি অফিসের স্টাফদের বাসা দূরে থাকায় রান্নাঘরও তৈরি করা হয়েছে। সেখানে স্টাফদের জন্যে দুপুরের খাবার তৈরি করা হয়।
সেবা নিতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাজান পাটওয়ারী জানান, একসময় ভূমি অফিসটাতে আসলে ঠিকমত বসতেও পারতাম না। আশে পাশে ছিলো পরিত্যক্ত জায়গা। সেবা দেওয়ার মধ্যেও ছিলো না তেমন মান। কিন্তু বর্তমানে সহকারি কমিশনার রেজওয়ানা তিনি এই অফিসটাকে মনোমুগ্ধকর সাজে সাজিয়ে তুলেছেন। বর্তমানে এই অফিসটা এই উপজেলার একটি রোলমডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেবা নিতে আসা কথা হয় শাহানা আফোরজের সাথে। তিনি জানান, একসসয় এই অফিসটাতে আসলে ঠিকমত বসার স্খানও পেতাম না। দাঁড়িয়ে থাকতে হতো অনেকসময় ধরে। কিন্তু বর্তমানে বসার জন্যে একটি গোলঘর করা হয়েছে। যেখানে আমরা ভালোভাবে বসে বিশ্রামও নিতে পারি। এছাড়াও সঠিক সময়ে সেবাও পেয়ে থাকি। উপজেলা ভূমি অফিসের পরিবেশটাও চমৎকার লাগে।
ভূমি অফিসের সবজি বাগানটি যিনি পরিচালনা করেন কথা হয় রাম বাবুর সাথে। তিনি জানান, ভূমি অফিসের একটি অংশে আবর্জনা বেষ্টিত পরিত্যক্ত জায়গার একটি কোনায় দিয়ে আমি অল্প কিছু সবজি বাগান করি নিজের জন্যে। অফিসের এসিল্যান্ড স্যার তা দেখে পরিত্যক্ত জায়গাটি পরিষ্কার করে সেখানে প্রায় ১৯ জাতের সবজি বাগান তৈরি করে দিয়েছেন। এখন এই বাগান দেখে আমার অনেক ভালো লাগে।
কথা হয় উপজেলার ভূমি অফিসের আরেক কর্মকর্তা রবিউলের সাথে তিনি জানান, একসময়ের এই উপজেলা ভূমি আর এখনকার ভূমি অফিসের মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। একসময় এই ভূমি অফিসটাতে মানুষ ঠিকমত আসতোও না। কিন্তু বর্তমান এসিল্যান্ড স্যারে ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে এমন সুন্দর হয়েছে পরিবেশ যে এখন এই এলাকার অনেক মানুষ ভূমি অফিসে পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে কোন কাজে নয়, ঘুরতে আসে।
কথা হয় উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) রেজওয়ানা চৌধুরীর সাথে। ভূমি অফিসকে ফুল, ফল, সবজি বাগানসহ মনোরম পরিবেশ তৈরি করার পরিকল্পনাটার বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, দেখেন আমি নিজে একজন নারী। পরিপাটি হয়ে থাকতে আমি সবসময়ই পছন্দ করি। তাছাড়াও চিন্তা করলাম আমি যেখানে থাকবো সেখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে খারাপ কি। আর এইসব পরিকল্পনাতে আমার তেমন একটা খরচও হয়নি। কারণ প্রতিটি কাজের সাথে একে অপরটি সম্পূরক হিসেব জড়িত। যেমন আমি রেকর্ডরুমের কাজ যখন শেষ করি তখন সেই কাজের অবশিষ্ট কিছু মালামাল থেকে যায়। সেই অবশিষ্ট মালামাল দিয়ে আমি আরেকটি কাজের বেশ কিছু অংশ সস্পন্ন করতে পেরেছি। আর তাছাড়া নিজের ইচ্ছা ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করার সাথে সাথে আমি ওনাদের সার্পোট পাই।
তিনি আরো জানান, সেবাপ্রত্যাশীরা যেন সেবা নিতে এসে হয়রানি বা তাদের কষ্ট না হয় সে ব্যাপারটিকে আমি অধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। তারা সেবা নিতে এসে যেন কোন কষ্ট না পায় তারজন্যে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, আমরা চাচ্ছি প্রতিটি ভূমি অফিস যেন জনবান্ধব অফিস হোক। উপজেলাতে বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে অনেকেই আসেন। তারা যেন বসার স্থানসহ উপযুক্ত পরিবেশে সেবা পেতে পারে সেজন্যে শাহরাস্তি ভূমি অফিস সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তিনি আরো বলেন, এটার পাশাপাশি আমরা চাই শুধুমাত্র উপযুক্ত পরিবেশই নয় সেবার মানও যেন ভালো হয়। সেখানে যে রেকর্ডরুম করা হয়েছে খুবই স্মার্টলি করা হয়েছে। গত ২০বছর আগের রেকর্ডও খুব সহজেই পাওয়া যায়। আমরা চেষ্টা করছি শাহরাস্তি উপজেলার মত সবগুলো উপজেলা ভূমি অফিস যেন জনবান্ধব ও সুন্দর পরিবেশবান্ধব ভূমি অফিস রূপান্তরিত করতে পারি।
ফম/এস.পলাশ/এমএমএ/