কোরবানি সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

।। মুহাম্মদ ইমদাদুল হক পাটওয়ারী ।। আল্লাহ্ পাকের অশেষ রহমতে সামনে ঈদুল আযহা । যাকে কোরবানির ঈদ বলা হয়ে থাকে । আরবি “ضحی ” যার বাংলা অর্থ হল উৎসর্গ করা । “‘উৎসর্গ করা ” শব্দের আরেকটি আরবি শব্দ হল “قرب” । আরবি “ضحی ” শব্দ থেকে “اضح” শব্দের সৃষ্টি । যার হোক; কোন ধরনের পশু কোরবানির উপযুক্ত এবং কোন ধরনের পশু কোরবানির উপযুক্ত নয় তা জানা খুবই জরুরি ।

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা অপেক্ষা আল্লাহ্ র নিকট অধিক প্রিয় মানুষের কোন আমল হয় না । কিয়ামতের দিন এর শিং ও পায়ের খুর সব সহ উপস্থিত হবে । এর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহ্ পাকের কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায় সুতরাং স্বচ্ছন্দ হ্রদয়ে তোমরা তা করবে । ( তিরমিজি , ইবনে মাজাহ)

কোরবানি প্রসঙ্গে নবী (সঃ) বলেছেন, যে কোরবানি করে তার জন্য প্রতিটি লোমের বদলায় ছওয়াব রয়েছে । অন্য বর্ণনায়, এর শিং গুলোর বদলায় বলা হয়েছে । (তিরমিজি)

যায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সাহাবীগন বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এই কোরবানি কি? তিনি বলেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আঃ) – এর সুন্নাত । তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এতে আমাদের জন্য কি ( সাওয়াব) রয়েছে? তিনি বললেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে । তারা বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! লোমশপশুদের পরিবর্তে কি হবে ( এদের পশম তো অনেক বেশি) ? তিনি বলেন, লোমশপশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকী রয়েছে । (ইবনে মাজাহ)

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সঃ) শিং ওয়ালা মোটা তাজা একটি মেষ কোরবানি করেছিলেন । এটি খেত কাল মুখে, চলত কাল পায়ে, দেখতে কাল চোখে । (অর্থাৎ উল্লেখিত অংগগুলো কাল বর্নের ছিল । ( তিরমিজি,ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)

যে ধরনের পশু কোরবানির জন্য উপযোগী নয়:

আলী (রাঃ)থেকে বর্নিত যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন চোখ-কান ভাল করে দেখে নেই ।আর আমরা যেন মুকাবালা, মুদাবারা, শারকা ও খারকা পশু কোরবানি না দেই ।

হাসান ইবনে আলী (রাঃ)———- আলী (রাঃ) সুত্রে নবী (সঃ) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন যে, المقابلٹ ( মুকাবালা) হল যে পশুর সামনের দিকে কানের এক পাশ কাটা , المدابرت (মুদাবারা) হল যে পশুর পিছনের দিকে কানের এক পাশ কাটা, الشرقاء ( শারকা) হল যে পশুর লম্বালম্বি ভাবে কান ছেঁড়া, اخرقاء ( খারকা) হল যে পশুর কানে ছিদ্র আছে । (তিরমিজি, আবু দাউদ )

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন চোখ ও কান ভালরূপে দেখে নেই । আর আমরা যেন এমন পশু দ্বারা কোরবানি না করি যা কানা, যার কানের একদিক কাটা, যার কানের গোড়া কাটা এবং যার কান ফাঁড়া এবং যার কানে ছিদ্র আছে । (নাসাঈ)
নাসাঈ শরীফে আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেকখানা হাদীসে বর্নিত আছে , লেজ কাটা পশু কোরবানি না করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সঃ) নির্দেশ দেন ।
নাসাঈ শরীফে আলী (রাঃ) বর্ণিত আরেকখানা হাদীসে বর্নিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) কানা পশু কোরবানি না করার জন্য বলেন ।

জুরাই ইবনে কুলায়ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি আলী (রাঃ) কে বলতে শুনেছেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) শিং ভাংগা পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন । এরপর আমি তা সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (রাঃ) এর নিকট উল্লেখ করলে তিনি বললেন: শিং এর অর্ধেক বা তার বেশি ভাংগা হলে সেই পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন । (নাসাঈ)

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) কানের অগ্রভাগ বা পশ্চাদ ভাগ কাটা বা ফাটা বা ছিদ্রযুক্ত পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন । (ইবনে মাজাহ)

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে (কোরবানির পশুর) চোখ ও কান ভালরূপে পরীক্ষা করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন । (ইবনে মাজাহ)

কোরবানির পশুকে হারাম না বলা:

উবাইদ ইবনে ফাইরূয (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি বারা ইবনে আযিব (রাঃ)- কে বললাম রাসুলুল্লাহ (সঃ) যে ধরনের পশু কোরবানি করতে অপছন্দ অথবা নিষেধ করেছেন সে সম্পর্কে আমাদের বলুন । তখন তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাতের ইশারায় বলেন; চার প্রকারের পশু দিয়ে কোরবানি করলে যথেষ্ট হবে না । অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, রুগ্ন পশু যার রোগ সুস্পষ্ট, পঙ্গু পশু যার পঙ্গুত্ব সুস্পষ্ট এবং কৃশকায় দুর্বল পশু যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে । উবাইদ (রঃ) বলেন, আমি ত্রুটিযুক্ত কান বিশিষ্ট পশু কোরবানি করা অপছন্দ করি । বারা (রাঃ) বলেন, যে ধরনের পশু তুমি নিজে অপছন্দ কর তা পরিহার কর এবং অন্যদের জন্য তা হারাম কর না । (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, নাসাঈ)

ইয়াযীদ নু-মিসর (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, একদা আমি উতবা ইবনে আবদুস সলামীর নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি:হে আবু ওয়ালীদ! আমি কোরবানির পশুর সন্ধানে গিয়েছিলাম কিন্তু আমি পছন্দসই কোন পশু পাইনি- একটি ছাড়া, যার কিছু দাঁত পড়ে গেছে । আমি সেটিকে ক্রয় ভাল মনে করিনি । এখন এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন ? তখন তিনি বলেনঃ তুমি সেটিকে আমার জন্য আন নাই কেন? আমি বললামঃ সুবহানাল্লাহ! সেটি আপনার জন্য জায়েজ এবং আমার জন্য নাজায়িজ? তিনি বললেনঃ হাঁ । তুমিতো সন্দেহ করছ, আর আমি তো সন্দেহ করছি না । বস্তুত রাসুলুল্লাহ (সঃ) মুসফারা, মুসতাসিলা, বাখকা, মুশায়’ইয়া ও কাসরা পশুকে কোরবানি দিতে নিষেধ করেছেন ।
১। المصفرٹ (মুসফারা) ঐ পশুকে বলা হয়, যার কান এমনভাবে কাটা যে, কানের ছিদ্র দেখা যায় ।
২। المستاصل ( মুসতাসিলা) ঐ পশুকে বলা হয়, যার শিং গোড়া থেকে ওপড়ানো ।
৩। البخقاء (বাখকা) ঐ পশুকে বলা হয়, যার একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে গেছে ।
৪। المڈیعت ( মুশায়’ইয়া) ঐ পশুকে বলা হয়, যে অত্যন্ত দুর্বল ও কৃষ্ঞকায়, এমনকি সেটি বকরীর সাথেও চলতে অক্ষম ।
৫। الکسراء (কাসরা) ঐ পশুকে বলা হয়, যার পা ভেঙে গেছে । (আবু দাউদ)

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, নবী (সঃ) কান কাটা এবং শিং ভাংগা পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন । (আবু দাউদ)

কতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হবে :
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ)থেকে বর্নিত ।
নবী (সঃ) বলেছেনঃ গাভী ও উট সাত ব্যক্তির পক্ষ হতে কোরবানি করা যাবে । (আবু দাউদ)

মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কোরবানি করা :

হানাশ (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আমি আলী (রাঃ) -কে দু’টি দুম্বা যবাহ করতে দেখে জিজ্ঞাসা করি, ব্যাপার কি? তখন তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমাকে এরুপ ওসীয়ত করে গেছেন যে, আমি যেন (তাঁর ইনতিকালেন পর) তাঁর পক্ষে কোরবানি করি । তাই আমি তাঁর পক্ষ হতে এ কোরবানি করছি । (আবু দাউদ, তিরমিজি)

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আমরা হুদায়বিয়ায় নবী (সঃ) এর সাথে একটি উট সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে এবং একটি গরুও সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করেছি । (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)

কত বয়সের পশু কোরবানি করতে হবে:

জাবির (রাঃ)থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, তোমরা দুই বছরের কম বয়সী পশু কোরবানি করো না । কিন্তু যদি তোমাদের পক্ষে কঠিন হয় তখন তোমরা এক বছর বয়সী ভেড়া যবেহ (কোরবানি) করতে পার । (ইবনে মাজাহ)

উপরোক্ত হাদীসের উপর ভিত্তি করে মাযহাবের ইমামগন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন । ঠিক আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম ইমাম-এ-আযম আবু হানিফা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সে সিদ্ধান্তের অনুসরণ করেই কোরবানি দিতে হবে ।

এখানে বিশেষ ভাবে স্বরন রাখতে হবে যে, কোরবানির পশুর মধ্যে যত ত্রুটিই থাকুক না কেন, তাকে অন্য মুসলমানের জন্য হারাম বলা যাবে না । (পূর্বে বর্ণিত উবাইদ ইবনে ফাইরূয (র) থেকে বর্ণিত হাদীস খানায় স্পষ্ট ভাবে বলা আছে)

আল্লাহ্ পাক আমাদেরক কোরবানির পূর্ন ফজিলত দান করুক । আমিন ।

আপনাদের খেদমতে : মুহাম্মদ ইমদাদুল হক পাটওয়ারী ।
আইনজীবী, জজ কোর্ট, চাঁদপুর ।

ফোকাস মোহনা.কম