।। এস ডি সুব্রত।। ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৭১ সালের এর এই দিনে পাকবাহিনী বাংলাদেশে এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায় । ২০১৭ সাল থেকে এ দিনটি আমাদের দেশে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো। আপামর জনতা বিদ্রোহ-ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সেদিন । ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশে পতাকা উত্তোলন হয় । ৩ মার্চ ঘোষণা হলো পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এরপর এলো বাঙালির বহুপ্রতীক্ষিত ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক পয়সায় আশিক ভাষন রাখলেন। ওই ভাষণে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুরু হল অসহযোগ আন্দোলন, যুদ্ধের প্রস্তুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে।
২৫ মার্চ। সন্ধ্যা থেকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। সেই দুঃসময়ের স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: আগুন জ্বলছে পলাশীর বস্তিতে, বিদ্রোহ ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে, দাউদাউ করে জ্বলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। রাতের শেষ প্রহরে কামানের গর্জন। আগুনের ফুলকি চতুর্দিকে। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি । সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নির্দেশে, জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের সামরিক অভিযানে সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘জেনোসাইড’-এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন হয়েছে সেদিন বাঙালির ওপর। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, জহুরুল হক হলসহ সারা ঢাকা শহরে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয় বিদেশি সাংবাদিকদের; যাতে করে কেউ গণহত্যার কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে না পারেন। আর্চার ব্লাডের লেখা দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অগণিত ছাত্রছাত্রী নিহত হয়েছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিস, প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে, কামান ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় শাঁখারীপট্টি ও তাঁতীবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে, বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লাখ লাখ নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল সেই বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা এবং সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদি নিধনযজ্ঞ ।রুয়ান্ডার গণহত্যাকেও অতিক্রম করে গেছে এ ঘটনা। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে সিলেক্টিভ জেনোসাইড বা জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ড্যান কগিন টাইম ম্যাগাজিন-এ এক লেখায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্ধৃতি প্রচার করেন: ‘আমরা যে কাউকে এবং যেকোনো কিছুকে হত্যা করতে পারি। কারও কাছে আমাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না।’
পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজের ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন। শ্রমিক কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল, ছাত্র-যুব-নারী সবার দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে দশম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশনে ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক’ প্রস্তাবটি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় আমি উত্থাপিত হয়।। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গণহত্যাসংক্রান্ত বিশেষ ভিডিও চিত্র ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন করেন। বিরোধীদলীয় নেতাসহ ৫৬ জন সাংসদ ও মন্ত্রী এই প্রস্তাবের সমর্থনে ৭ ঘণ্টা যাবৎ আলোচনায় অংশ নেন। সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাবটি পাস হয়।
শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত একটি দিন গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন, পৃথিবীরবীর আর কোথাও যাতে আর কখনোই এ রকম গণহত্যার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাই ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্তটি ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
sdsubrata2022@gmail.com