।। মোঃ মহসিন হোসাইন ।। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ পৃথিবীতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিক আছে যা পার্থক্য নির্ণয় করার জ্ঞানবুদ্ধি মানুষের রয়েছে। এখানেই অন্য প্রাণীদের চেয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু জন্মসূত্রে মানুষ হলেই কি আদতে মানুষ হওয়া যায়? মানবশিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে থাকে শুভ্র মুক্তোর মতো নিষ্কলুষ ও পবিত্র, সব ধরনের অন্যায় আচরণ, পরশ্রীকাতরতা ও বিভেদমূলক চিন্তাধারা থেকে মুক্ত। কিন্তু শয়তানের কুমন্ত্রণায় ও আমাদের পরিবেশের নানা অসঙ্গতি দেখে মানুষে-মানুষে বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে। মানবসমাজে নিয়ে আসে বিভীষিকা। আজ ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষা ও চিন্তাধারা ভেদাভেদে একাংশ মানুষ হয়েছে মানুষের শত্রু। সমাজ যেমন এগোচ্ছে, নানাভাবে পেছাচ্ছেও। চতুর্দিকে আজ নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ হারানোর হাহাকার। অথচ এ পৃথিবীতে মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাজ গঠনের অসংখ্য নজির রয়েছে।
বর্তমানে মানুষের আচরণ খুবিই অদ্ভুত ও বৈচিত্র্যময়। আমরা অন্যের হেয় প্রতিপন্ন ও ক্ষতি করার নেশায় বিভোর হয়ে পড়ি। সমাজে প্রতিনিয়ত নানা অপকর্ম এবং অঘটন ঘটছে। এমনকি স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে, সন্তান মা-বাবাকে অবলীলায় হত্যা করছে। চারদিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে যে কোনো বিবেকনিষ্ঠ মানুষের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা এক অনিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা যেন তলানিতে পৌঁছেছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই’ কথাটি আজ আমরা ভুলতে বসেছি। আর কবে আমাদের অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা মানবতা জেগে উঠবে!
অতি আধুনিকতার নামে আমাদের অনেকেই নিজের শিকড় পর্যন্ত ভুলে যায়। যে মাতা-পিতা নিজেদের সুখকে বিসর্জন দিয়ে অসহনীয় কষ্ট করে সন্তানের সাফল্য চেয়েছেন; তাদেরই অনেকে বোঝা মনে করে। তাদের ওপরই যেন দেখাতে হয় সব ক্ষোভ! যাদের ছাড়া আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকত না, তাদের আমরা চরমভাবে অবহেলা করে বসি। সমাজে আজ বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ আমার পিতা যদি একজন ভিক্ষুকও হয়, আমার গর্ব করে বলা উচিত, তিনি আমার বাবা। একটু চিন্তা করে বলুন তো, আপনি ভালো কিছু করলে বা প্রতিষ্ঠিত হলে সবচেয়ে কোন মানুষটি গর্ব করে আপনার কথা বলবে? উত্তরটি নিশ্চয়ই মা-বাবা। কিন্তু যান্ত্রিক এই পৃথিবীতে আমরা আসল প্রশান্তি থেকে দূরে গিয়ে মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছি। অর্থ প্রেম মানুষকে মানবিকতা বিবর্জিত যান্ত্রিক মানুষে পরিণত করে তুলছে। কিন্তু যারা ‘অর্থের জন্য জীবন নয় বরং জীবনের জন্য অর্থ প্রয়োজন’ বলে মনে করেন তারা হতাশাগ্রস্ত ও বিষ্ণনতায় ভোগেন না।
আলোকিত সমাজ গড়তে মানুষের চিন্তাধারা ও কার্যক্রমে ইতিবাচকতার চর্চা অতিব জরুরি। আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে জাগ্রত হতে হবে যাতে অপরাধ করে কেউ মানসিক তৃপ্তিবোধ না করেন। কিন্তু কেউ বিষ্ণনতায় ভুগলে, সান্ত্বনা দেওয়ার চেয়ে উপহাস করতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আবার সেই ব্যক্তিটি যদি একপর্যায়ে আত্মহত্যা করে, তখন আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাঁপিয়ে ফেলি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা থেকে সবাই বিরত থাকুন ইত্যাদি। এই হলো আমাদের মানসিকতা!
দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এরা না পায় একটি কাক্সিক্ষত চাকরি, না পারে যে কোনো কাজে যোগ দিতে। ফলে এসব তরুণরা হতাশ হয়ে পড়েন। এদের সমাজের অনেকেই ছোট করে দেখেন। মাঝেমধ্যে বেকার তরুণদের পিতা-মাতার প্রতিও আসে নানা অসামাজিক আচরণ। ছেলে বেকার জেনেও যখন বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার ছেলে কি করে? এটা একজন বাবার জন্য প্রশ্ন না বলে বুলেট বললেই বোধহয় সমুচিত হবে। কলিজা বিদ্ধ করার জন্য এটাই যথেষ্ট! বেকার হওয়ার দোষটা কি একান্তই বেকারের! নাকি আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরো ঢেলে সাজাতে হবে। স্বল্প ভূমি ও মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার এই দেশে তরুণদের কর্মসংস্থান তৈরির জন্য উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরির জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে নতুবা এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়।
গরিবের প্রতি আমরা অনেকেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠি। আমরা একজন অসহায় রিকশাচালকের সঙ্গে পাঁচ টাকার জন্যও প্রচন্ড দর-কষাকষি করি অথচ আমোদ-ফুর্তি আর বিলাসিতায় অঢেল অর্থকড়ি নষ্ট করি। ক্ষুধার্ত পথশিশুরা সাহায্যের জন্য ছুটে এলে তাদের প্রতি আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকে না। একজন অসহায় মানুষকে সাহায্য করার সময় আমরা মানিব্যাগের সবচেয়ে ছোট নোটটি খুঁজি অথচ মাজারে গেলে দুহাত বিলিয়ে দান করি। মুমূর্ষু স্বজনের সেবা বা তার ছোট্ট আকাক্সক্ষা পূরণ না করে; তার মৃত্যুর পর বিশাল মিলাদের আয়োজন করি। গরিবের হক মেরে আকাশচুম্বি ইমারত ও অর্থবৃত্তের পাহাড় গড়ি। অথচ সেই গরিব মানুষটি দুবেলা অন্ন জোগাতে হিমশিম খায়। অনেকেই জুতা পরা অবস্থায় মেরামতকারীর দিকে পা বাড়িয়ে দেন। কেন, সে গরিব বলে কি মানুষ না! আপনার মতো সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ পেলে হয়তো সে বিশ্বজয় করতে পারত। পেটের দায়ে যে ব্যক্তিটি চুরি করে, তার বিচার করতে আমরা মহাব্যস্ত। তার জায়গায় নিজেকে কখনই বসিয়ে দেখি না, এমন পরিস্থিতিতে পড়লে আমি কি করতাম। অথচ সমাজের অনেক প্রভাবশালী ও রাজনীতিকরা যখন ‘সাগর চুরি’ করে, তখন আমরা সেটা কৌশলে এড়িয়ে যাই। তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির স্বভাব। এ প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিবেশ অধিকাংশ ব্যক্তির আচরণের রূপরেখা গড়ে থাকে। তাই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তির আচরণের দিকে নজর দিতে হবে। দিন দিন আমাদের পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। আমরা বাস্তবের চেয়ে ভার্চুয়াল জগৎকে প্রাধান্য দিচ্ছি। অধিকাংশই বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা ও সামাজিকতাকে উপেক্ষা করে বিধ্বংসী ভিডিও গেম, পর্নোগ্রাফি ও অনলাইনের অন্ধকার জগতেই মেতে উঠছি। আমরা এখন বৃষ্টিতে ভেজার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি, ভুলতে বসেছি প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে সবার মধ্যে থেকেও সবাই যেন একা। তরুণ প্রজন্ম আজ সারাক্ষণ নেশাগ্রস্তের মতো হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পাতি নেতা ও সেলিব্রিটিদের সঙ্গে ছবি তুলে পোস্ট করার হিড়িক পড়েছে। আচ্ছা, এমনটা করলে কি আপনিও বিশেষ কেউ হয়ে যাবেন? আমাদের নিজের পরিচয়ে বড় হওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। এ জন্য পরিবার থেকেই সন্তানদের মানবিক শিক্ষা দিতে হবে নতুবা ভবিষ্যৎ অন্ধকার, অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সমাজে নারী নির্যাতন ও উত্ত্যক্তকরণ প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিবাহ উপযুক্ত একটি মেয়েকে কলঙ্ক দিতে বা বিবাহ ভেঙে দেওয়ার কাজে পটু আমরা। অন্যের সফলতায় যেন নিজের গা জ্বালা করে। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাটা এখন জরুরি। সুস্থ সমাজ গঠনে মানবিক মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক শৃঙ্খলা কেন এভাবে ভেঙে পড়ছে, কেন সামাজিক পচন তীব্রতর হয়েছে, কেন আমাদের বোধদয় আজ তলানিতে- তার কারণ অনুসন্ধান করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া ব্যাপকভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে নতুবা এ সমাজ একদিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।
একটি দেশের সব উন্নয়নমূলক কাজ, সামাজিক সংস্কার, কর্মসংস্থানসহ সব ধরনের সমস্যার সমাধান করা এককভাবে কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের মানুষদেরও নাগরিক দায়িত্ব রয়েছে। সরকার করে দেবে এমন ভাবনায় হাতগুটিয়ে বসে না থেকে নিজেদের প্রচেষ্টায় সামাজিক পুঁজির শক্তিতে সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের সহযোগী ভূমিকায় কাজে লাগতে পারে সামাজিক পুঁজি। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটি জটিল প্রবণতা রয়েছে, তা হলো আমাদের সব কাজ করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
দারিদ্র্য মুক্তির জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। সমাজের সব ধনী মানুষ যদি গরিব মানুষের কল্যাণে তাদের অর্জিত অতিরিক্ত সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে ব্যয় করেন; তাহলেও দারিদ্র্যবিমোচনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। এভাবে প্রত্যক সামর্থ্যবান মানুষ যদি নিজ নিজ গ্রামের গরিব এবং অসামর্থ্যশীল আত্মীয়স্বজনকে দোকানপাট, কুটির শিল্প, নৌকা, ট্রলার, ভ্যানগাড়ি, মাছ ধরার জাল, রিকশা বা উপার্জনমুখী ব্যবস্থায় দান বা সহায়তা করেন; তাহলে সামাজিকভাবে সর্বোপরি রাষ্ট্রের মাঝে ধনী-দরিদ্রের বিস্তর ব্যবধানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এভাবে সমাজের সবস্তরের মানুষ যদি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করেন; তাহলে আমাদের সমাজ থেকে বস্তিবাসী, ছিন্নমূল, টোকাই, পথশিশু এসব নির্মম মানবতার শব্দগুলো বিলুপ্ত হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন আনতে পারি। এজন্য শুধু ধনের নয়, মনের দারিদ্র্যও দূর করা দরকার।
লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক
কেন্দ্রীয় সভাপতি- মানবতার ডাক সাহিত্য পরিষদ।
mohsinhossain117@gmail.com