।। রিফাত কান্তি সেন।। “গ্রাম হবে শহর” কথাটি একবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। আমাদের দেশের প্রত্যান্তঞ্চল গুলো এখন আর পিছিয়ে নেই। থাকবার কথা ও না। যুগের হালে পালটেছে সব। এক সময়কার কুঁড়েঘর গুলো এখন আর তেমন চোখে পরে না। চোখে পরে না গ্রাম্য সেই পরিবেশ। অনেকটা আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামে। তবে এখনো স্নিগ্ধতা উঁকি মারে। শীতল হাওয়া, নয়ন জুড়ানো সবুজের মাঠ। কৃষাণীর গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু। তবে সে দৃশ্যটা অনেকটাই ছোট হয়ে আসছে। খুব কম বাড়িতেই এখন গৃহস্থালীর কর্ম হয়। ফসলের মাঠ তো এখন সোনার হরিণ। এক সময় যেখানে প্রতিটি বাড়িতেই মানুষের অন্তত পক্ষে ফসল ফলানোর দু’একজন ছিল, এখন সেটা দুঃস্বপ্ন। শহরের বাতাস গাঁয়ে মাখাতে গিয়ে শহুরে হয়ে উঠেছি। স্রষ্টার আশির্বাদকে ভুলতে বসেছি। ঠিক যেন পালের হাওয়া গায়ে লাগাতে গিয়ে গ্রামকে ধ্বংশ করার মহা প্রচেষ্টা আমাদের। বন উজাড় করে তৈরি করছি মস্ত বড় প্রাসাদ-অট্টালিকা। ফসলি জমি নষ্ট করে সেখানে গড়ে তুলছি বসতি। একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে যে যার ‘আখের গোছানোর’ ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পরছি। মুখে বুলি ছাড়ছি গ্রাম হচ্ছে শহর! হোক না শহর কিন্তু মানুষগুলো যেন শহুরে না হয়। ইট পাথরের দেয়ালে ঘেরা আমাদের জনজীবনে ব্যস্ততাকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত আমারা কত রকমের অযুহাত খুঁজছি। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সম্পর্কে ফাটল ধরাচ্ছি। নিজের গাম্ভির্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে হিংসুটে হয়ে উঠছি। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে না এসে বরং তামাশা করছি।
ছোটবেলায় শুনেছি এখনকার অনেক বড় বড় মানুষেরাও নাকি অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে, গায়ে খেটে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজেছে। এখন তো তারাই নাকি শিল্পপতি, সমাজ সেবক হয়ে নিজের বাড়িতে বাউন্ডারি টানছে। সন্তানদের ও শিখাচ্ছে ” অমুকের সাথে মিশা যাবে না! নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখ। পড়ালেখা ভাল করে কর। বন্দী জীবনে আটকে দিচ্ছে।
শহরে এসব আগে থেকেই চলতো। এখন গ্রামেও চর্চা হচ্ছে। মানুষে মানুষে দুরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। অবকাঠামো, রাস্তাঘাট সবই উন্নত হচ্ছে, কিন্তু মানুসিকতার পরিবর্তন ঘটছে না। সবই যেন পাল্টে যাচ্ছে। এদিকে আবার শুনছি খাদ্য সংকট ও দেখা দিচ্ছে। দিবেই বা না কেন। বেশীর ভাগ লোকই তো এখন কৃষির প্রতি উদাসীন। গ্রামের লোকেরা ও ভাবতে শুরু করেছে সরকার খাবারের ব্যবস্থা করবেই।
ফসল ফলানোর চেয়ে যদি কিনে খাওয়া যায় সেটা মন্দ কি। তাছাড়া আমাদের সন্তানরা কেন কৃষির প্রতি ঝুঁকবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দাড়গোড়ায় দাড়িয়ে কি আর গ্রামীণ-ক্ষেতের মত জীবন যাপন করা যায়। আধুনিক তো হতে হবে। আর তাতেই যেন সংকটের বীজ বপণ করছি প্রতিনিয়ত। কৃষক কমে যাচ্ছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোও এখন চালাক হওয়ার দৌঁড়ে অংশ নিচ্ছে। তারা বুঝে উঠতে পারছে না এটি বিপ্লব নয়! এটি অশনি সংকেত। পেটে খাবার থাকলেই তো স্বপ্ন দেখতে পারবো। আর তাই গ্রামকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রাম হোক শহর তাতে আপত্তি নেই, মানুষগুলো যেন শহুরে না হয়।
স্পস্ট মনে আছে, সদরঘাটের খুব কাছে রাত তখন সাড়ে এগারোটা। খুব কাছাকাছি একজনকে ফোন দিলাম তার বাসায় থাকা যাবে কি না? উত্তরে তিনি নানা অযুহাত দেখালেন। মানুষের তিন হাত। ডান-বাম আর অযুহাত।
অথচ তিনিও গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। আমি কিছুটা সময়ের জন্য ভাবলাম, আমার গ্রামের মানুষ যদি জানতো যে আমি বিপদে আছি তারা তো ঠিকই আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করতো।
এমনকি আপ্যায়নেও ত্রুটি রাখতো না। কিন্তু শহুরে হাল লাগাতে আমার গ্রামের মানুষটাও এখন একা বাঁচতে শিখছে। কিন্তু একা কি বাঁচা যায়? শহরে কেউ কারো খবর নেয় না। আমি কিভাবে বেঁচে আছি, এসে দেখে যা নিখিলেশের মতই। নিজে খাও, নিজে বাঁচো নীতিতে অটুট। পঞ্চায়েত ব্যস্ত রাজনীতিতে। ও রাজনীতি কিন্তু এখন আর রাজারনীতি নেই। লাখো কোটি টাকা খরচা, সেগুলো তো জনগনের থেকেই উঠাতে হবে। গ্রামের মানুষকে বোকা বানানো সোজা। খুব দ্রুতই পুঁজি উঠে যাবে। অট্টালিকার স্বপ্নে বিভোর মানুষ ভুলে যাচ্ছে পেট বাঁচলে তো তবে পিঠ বাঁচবে। তাই গ্রামের শহরের ছোঁয়া লাগুক, কিন্তু মানুষগুলো আগের মতই থাকুক।