জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন : ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক প্রথম উপন্যাস 

ছবি: সংগ্রহীত।
এস ডি সুব্রত।। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল এদেশের ভাষা শহীদেরা ।  বাংলার দামাল  ছেলেরা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল মায়ের ভাষা ।  ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত হয়েছে হাজারো কবিতা , গল্প  গান  । রচিত হয়েছে নাটক উপন্যাস । ভাষা আন্দোলনের তিন বছর পরে আসা আরেক ফাল্গুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি এবং সরকারি বাধাকে উপেক্ষা করে তাদের অন্যায়কে প্রতিহত করার ঘটনাকে  কেন্দ্র করে জহির রায়হান রচনা করেছেন  ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন।’
সময়টা ১৯৫৫ সাল। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে ছাত্রদেরকে ‘শহীদ দিবস’ পালন করতে দেবে না সরকার। রাস্তায় স্লোগান দেওয়া নিষিদ্ধ। মিছিল, শোভাযাত্রা সবই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে হারানো শহীদদের স্মৃতি গভীর ভালবাসায় লালন করছে তারা যে কোন মূল্যে শহীদ দিবস পালন করতে প্রস্তুত । প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে । নগ্ন পায়ে চলা, শহীদদের স্মরণ করে রোজা রাখা, কালো ব্যাজ ধারণ করে ২১ ফেব্রুয়ারিতে কালো পতাকা উত্তোলন করা সহ নানাভাবে প্রস্তুতি চলতে থাকে। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান, যিনি শুধু একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকই নন, একাধারে ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যান্য সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের তুলনায় অগ্রগামী, যার ফলে তাঁর কাজগুলো যুগে যুগে মানুষের দ্বারা হয়েছে প্রশংসিত ও সমাদৃত। ভাষা আন্দোলনের উপর রচিত তার ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ‘ আরেক ফাল্গুন’  কাহিনীর স্থিতিকাল মাত্র তিনদিন দুই রাত। প্রথম দু’দিন এবং দুই রাত ধরে চলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের বিরামহীন প্রস্তুতি। এরপর তৃতীয় দিনে শহীদ দিবস পালনের মিছিলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ এবং প্রতিবাদী ছাত্রদের গ্রেফতার করে দমিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চিত্রায়ণের মাধ্যমে জেলগেটের সামনে এ উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। উপন্যাসের শুরুটা বেশ নাটকীয়। সকালে কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিল পুরো আকাশটা। আকাশের অনেক নিচু দিয়ে মন্থর গতিতে ভেসে চলেছিল এক টুকরো মেঘ। উত্তর থেকে দক্ষিণে। রঙ তার অনেকটা জমাট কুয়াশার মতো দেখতে। ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মতো একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেল নবাবপুরের দিকে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পরনে তার সদ্য-ধোয়ানো সাদা সার্ট। সাদা প্যান্ট। পা-জোড়া খালি। জুতো নেই। সিপাহী বিদ্রোহের নির্মম স্মৃতি বিজড়িত ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে এই মেঘের মতো হেঁটে যাওয়া ছেলেটিই ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিম। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। জহির রায়হান সিপাহী বিদ্রোহের  সাথে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিবাদী চেতনার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছেন এ উপন্যাসের  শুরুতে। স্বৈরাচারী সরকারের সকল বাধা উপেক্ষা করে শহীদ দিবসকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে মুনিমের মতো আসাদ, সালমা, নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, কবি রসুল দিন রাত কাজ করে যায়। পোস্টার ও লিফলেট ছাপানো, কালো ব্যাজ বিতরণ, স্লোগান ও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সকলেই অত্যন্ত  সক্রিয়। সকলৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ কীভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং প্রতিরোধে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে, তার একটি অনন্য  চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এ উপন্যাস।   প্রিয়জন হারানোর বেদনা, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যকার প্রেম-ভালোবাসা ও হৃদয়ঘটিত অনুভূতির  সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে  এই উপন্যাসে।  শহীদ দিবস পালনে বাধার সম্মুখীন হয়ে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে প্রেমিকা ডলির জন্মদিনের উৎসবেও মুনিম  হাজির হয় খালি পায়ে। প্রেমিকা ডলি তাকে খালি পায়ে দেখে অস্থির হয়ে বলে,–“আমায় অমন করে অপমান করতে চাও কেন শুনি? …এখানে জুতো পায়ে দিয়ে এলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো না!” এরপর তাকে ডলির বাবার জুতা পরার পরামর্শ দিলে মুনিম উত্তর দেয়,”জানো তো আমরা তিনদিন খালিপায়ে হাঁটা- চলা করছি। …আমায় তুমি ইমমোরাল হতে বলছো?” ক্রোধান্বিত ডলির সাথে সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে মুনিমের। মুনিমের মতো আরেকজন আপোসহীন একনিষ্ঠ বিপ্লবী ছাত্রকর্মী আসাদ। কোনো প্রতিকূলতাই তাকে আন্দোলনের মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে কালো ব্যাজ ও কালো পতাকা বিতরণসহ সব কাজে সে ছিল ক্লান্তিহীন। এজন্য উপন্যাসের শেষের দিকে মুনিমের চেয়ে আসাদ চরিত্রটিই বিশেষ আলো ছড়ায়। অন্যদিকে মেডিকেলের ছাত্রী সালমা কারারুদ্ধ বিপ্লবী রওশনের স্ত্রী। স্বামীর জন্য হৃদয়ে গভীর ভালবাসা লালন করে আন্দোলনে সে অত্যন্ত কঠোর । রাজশাহী জেলে পুলিশ গুলি চালালে রওশন তার হাত দুটি হারায়। স্বামী রওশনের খণ্ডিত হাত আর কখনো স্লোগানে উত্তেজিত হবে না, সালমার এমন বেদনা পাঠকদেরকে আবেগাপ্লুত করে।    ছাত্রদের সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি  উপন্যাসে উঠে এসেছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর চরিত্র। ছাত্রদের মাঝে লুকিয়ে থাকা গুপ্তচর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মেরুদণ্ডহীন প্রক্টরের  বিবেকহীনতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র- নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, কবি রসুল প্রমুখও রাজপথে তাদের আন্দোলন নিষিদ্ধ জেনেও পিছু হটে না । একুশে ফেব্রুয়ারি  সকল ভয়  ভীতি উপেক্ষা করে তারা কালো পতাকা উত্তোলিত করে। ছাত্রদের স্লোগান ও ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, এরপর মেডিকেলের ব্যারাক ঘেরাও করে ছাত্রছাত্রীসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর সকাল ১০টার দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে যখন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জমায়েত হতে শুরু করে এবং সেখানে কালো পতাকা উত্তোলন হয়, সেখানেও পুলিশ গুলি চালায়, অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয় আবার অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। প্রিজন ভ্যানে উঠে তারা স্লোগান দিতে থাকে ‘শহীদের খুন ভুলব না, বরকতের খুন ভুলব না’; ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। মূলত সংগ্রামী চেতনার সাথে লেখকের রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির নিবিড় সম্মিলন ঘটেছে এ উপন্যাসে।’ নাম ডেকে ডেকে ছেলেমেয়েদের ঢোকানো হচ্ছিল জেলখানায়। নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। এক সময় বিরক্তির সঙ্গে বললেন, উহ অত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়? জেলখানাতো এমনি ভর্তি হয়ে আছে। তখন  কবি রসুল চিৎকার করে বলছিল , জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না। আরেকজন  বলল, এতেই ঘাবড়ে গেলে নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।”  জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন , অত্যচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস । বাংলার ছাত্র সমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে , অত্যাচারীর বিরুদ্ধে কীভাবে রুখে দাঁড়ায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে তাঁর এক অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলেছেন জহির রায়হান  তাঁর  এই উপন্যাসে ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম