বেহুলা লক্ষিন্দর

এস ডি সুব্রত।। শ্রাবণের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় মনসা পূজা ।  মনসা দেবীর নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা , বেহুলার ভেলা , বেহুলা লক্ষিন্দরের লোহার বাসরঘর । মনসা মানেই সাপের দেবী ।মনসা দেবীর কাহিনী নিয়ে রচিত মনসামঙ্গল কাব্য মধ্যযুগের অনন্য কীর্তি । মনসা মঙ্গলের বেহুলা লক্ষিন্দর কথা সবাই জানে । চিরায়ত বাংলার অনুপম চরিত্র বেহুলা লক্ষিন্দর ।
লক্ষিন্দরের পিতার নাম চাঁদ সওদাগর এবং মায়ের নাম সনকা। বাস করতেন চম্পক নগরে । চাঁদ সওদাগরের সাত পুত্র : ত্রিলোচন, দিগম্বর, হরিহর, কৃষ্ণাদাস, বিষ্ণুদাস, গুণ্যকর এবং লক্ষিন্দর।  চাঁদ ছিলেন শিবের পুজারী। চাঁদ সওদাগর  শিবের পূজা করে ‘হেমতাল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।হেমতালের এমনি গুণ, যার গন্ধে সাপ কাছে আসে না। হেমতাল ছিল এক ধরনের গাছ। এছাড়া চাঁদ  ‘মহাজ্ঞান’ শক্তির অধিকারী হওয়ার ফলে তিনি সাপে কাটা রোগীকে ভাল করতে পারতেন। আবার  ওঝা ধন্বন্তরী নামে একজন বন্ধু ছিল চাঁদ সওদাগরের । দেবী মনসার  পদ্মা ও বিষহরি  নামেও পরিচিত। তাঁর স্বামীর নাম জগৎকারু । পদ্মা বাসুকি রাজের ঘরে প্রতিপালিত হন। বাসুকি কন্যা স্নেহ-যত্নে তাঁকে লালনপালন করেন। পদ্মপাতায় জন্ম বলেই তাঁকে পদ্মা নামে অভিহিত করা হয়। আর, বাসুকিরাজ  ঘরে প্রতিপালিত বলে তাঁকে নাগকন্যা বলা হয়। পদ্মা দেবী প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে বাসুকিরাজকে তাঁর পিতার কথা জিজ্ঞেস করেন এবং জানতে পারেন তাঁর পিতা মহাদেব। পিতার সাথে দেখা করে মানুষের পূজা পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন ।কন্যার  কথা শুনে মহাদেব  বললেন, ‘তোমার পূজা কেউ করবে না মা। তবে চাঁদ সওদাগর যদি তোমার পূজা করেন, তবে নরলোকে তুমি পূজিত হবে। চাঁদ সওদাগর পূজা না-দিলে কেউ তোমাকে পূজা দিবে না।’
এরপর মনসা যান পৃথিবীতে। চাঁদ সওদাগরকে পূজা দেওয়ার কথা বললেন। আরো বললেন, পূজা না-দিলে তোমাকে  নির্বংশ করব আমি ।  কিন্তু চাঁদ সওদাগর ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি না করে দিলেন । এর পর চাঁদ সওদাগর তাঁর ছয় পুত্রকে নিয়ে বাণিজ্যে যান এবং বাণিজ্যশেষে কালিদহ দিয়ে গৃহে ফিরছিলেন। তখন সওদাগরের ছয় পুত্র সাপের কামড়ে মৃত্যবরণ করে এবং পদ্মা মায়াবলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরীসহ তাঁকেও কালিদহে ডুবিয়ে দেন।সওদাগর ,কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেন। পুত্রশোক এবং ধন-রত্ন হারিয়ে তিনি এত কষ্ট পেলেন, তবুও মনসার পূজা দিবেন না প্রতিজ্ঞা করলেন। সেই সঙ্গে আরো প্রতিজ্ঞা করলেন, দেবীকে এমন শাস্তি দিবেন—যা চিরকাল দেবী ভুলতে না পারে। বেহুলার পিতার নাম মুক্তেশ্বর ওরফে বাসোবানিয়া, মায়ের নাম কমলা। বাসোবানিয়ার ছয় পুত্র ও এক কন্যা।
এদিকে, পদ্মাদেবী স্বপ্নে বেহুলাকে জানালেন লক্ষিন্দরকে বিয়ে করতে। আরো বললেন, লক্ষিন্দরকে বিয়ে করলে তিনি বেহুলার কাছে ধরা দিবেন। বেহুলা তাঁর স্বপ্নের কথা পিতাকে জানালে লক্ষিন্দরের সাথে বেহুলার বিয়ে দেন ।তখন মনসা চাঁদ সওদাগরের কাছে এসে জানালেন, ছয় পুত্রকে তো নিয়েছি-এবারে আমার  পূজা না-দিলে বাসরঘরেই পুত্রের মৃত্যু নিশ্চিত। সওদাগর তবুও মনসার পূজা দিবেন না জানিয়ে দিলেন। পূজা না-দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। তিনি বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করলেন এবং বিশ্বকর্মা একজন কর্মাকে পাঠিয়ে দিলেন । এক রাতের মধ্যে বাসরঘর বানানো হলো। কিন্তু ঐ কর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং মনসার কথামতো একটি ছিদ্র রেখে দিলো বাসরঘরের দেয়ালের মেঝের একটি কোণে। চাঁদ সওদাগর শুধু লোহার বাসরঘর বানিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, তিনি বাসরঘরের উপরে ময়ূর, নিচে নেউল এবং অসংখ্য প্রহরী দ্বারা ঐ জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ করলেন। বিয়ের পর বেহুলা-লক্ষিন্দর এখানেই বাসর সাজালেন। বাসররাতে মন্ত্রবলে বেহুলাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মনসা এবং কালনাগকে পাঠিয়ে  ধ্বংসন করালেন্য   লক্ষিন্দরকে। বেহুলা স্বামীর লাশ নিয়ে ভেলায় ভেসে ইন্দ্রপুরীতে যায় । সেখানে নৃত্য করে দেবতাদের খুশি করলে তারা লক্ষিন্দরের জীবন ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় । তবে শর্ত থাকে মনসার পূজা করতে হবে চাঁদ সওদাগরকে  ।  এভাবে বেহুলা তার  স্বামী লক্ষিন্দর ও চাঁদের ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে আনে মনসার পূজা দেবার বিনিময়ে । শেষে চাঁদ সওদাগর মনসার দিকে না তাকিয়ে বা হাতে ফুল দিয়ে পূজা করেন ।  মনসা এতেই খুশি হয়ে চাঁদ সওদাগরের পুত্রদের জীবন ফিরিয়ে দেন । এভাবে পৃথিবীতে মনসার পূজা চালু হয় এবং আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা লাভ করে ।আর বেহুলা লক্ষিন্দর  চরিত্র চিরায়ত রুপ লাভ করে ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক,সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম