কারবালার তাৎপর্য ও শিক্ষা

মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন।। হোসাইন (রা.) কারবালার ময়দানে কি উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাস কখনো একথা স্বীকার করে না, তিনি জিহাদের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলেন। এর কিছু মজবুত প্রমাণ আছে- এক. তিনি জিহাদের জন্য গেলে জিহাদের ঘোষণা দিয়ে যেতেন, তা তিনি করেননি। দুই. এ উদ্দেশ্যে গেলে অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় যেতেন, তাও ঘটেনি। তিন. উদ্দেশ্য জিহাদ হলে নারী-শিশুদের সঙ্গে নিতেন না। চার. উদ্দেশ্য জিহাদ হলে ইয়াজিদের বাহিনী কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের যুদ্ধের প্রস্তাবে তিনি যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানাতেন না? এবং সীমান্তবর্তী কোথাও চলে যাওয়ার আবেদন এবং ইয়াজিদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতে অনুরোধ করতেন না?

এ থেকে বুঝে আসে হোসাইন (রা.) কারবালায় গমন জিহাদের উদ্দেশ্যে ধরা যাবে না। কেননা তখন তাকে ‘যুদ্ধ থেকে পলায়নের’ মতো কঠিন অভিযোগে অভিযুক্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। অথচ একজন জলিলুর কদর সাহাবির ব্যাপারে এ ধরনের মন্তব্য করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদার খিলাফ।

পাঁচ. যদি জিহাদের উদ্দেশ্যে গমন করতেন তাহলে হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার দিকে রওনাকালে বিজ্ঞ বিজ্ঞ সাহাবায়ে কেরাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইবনে জুবায়ের ইবনে ওমর, (রা.) যারা জিহাদের জন্য সর্বক্ষণ উদগ্রীব তারা কেন তাকে যেতে বাধা দিলেন।

ছয়. কারবালার উদ্দেশ্যে গমনকালে তাকে যখন বারণ করা হচ্ছে, তখন তিনি এ কথা কেন বললেন না, আমি জিহাদের মতো মহান কাজে যাচ্ছি আপনারা কেন আমাকে বাধা দিচ্ছেন, পক্ষান্তরে তিনি তাদের উত্তরে বলেছিলেন, কুফা থেকে শত শত চিঠির মাধ্যমে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের চাওয়া আমি যেন তাদের খলিফা নিযুক্ত হই। এভাবে হোসাইন (রা.)-এর উত্তর দেয়ার অর্থ কি হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তিনি কোন উদ্দেশ্যে গমন করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাস এ কথাই বর্ণনা করে, ইয়াজিদের শাসনে কুফাবাসী অসন্তুষ্ট ছিলেন। জনগণ রাসুল (সা.)-এর পৌত্রকে খলিফা দেখতে চান। তাই হোসাইন (রা.) আজিমত প্রতিষ্ঠা করার জন্য সফর শুরু করেন। আর আজিমত প্রতিষ্ঠার জন্য যেহেতু কোনো শাসন সংগ্রাম এবং জিহাদ চলে না তাই ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এই ছিল হোসাইন (রা.)-এর কারবালার গমনের রহস্য। যা ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায়।

কারবালার তাৎপর্য: কারবালার তাৎপর্য নিয়েও সমাজে কিছু বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা দেয়া হয়, যা কারবালার তাৎপর্যের সঙ্গে কখনোই মানানসই নয়। যেমন বলা হয়ে থাকে, হোসাইন (রা.) কারবালায় গিয়েছিলেন বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, বাতিলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এবং রাজতন্ত্র উৎখাতের জন্য।

মুয়াবিয়া (রা.)-এর মনোনয়ন নিছক পুত্র হিসেবে ছিল না বরং যোগ্য পুত্র হওয়ার কারণেই ইয়াজিদকে খলিফা নির্বাচন করেছিলেন, তাহলে তো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাহলে কোন রাজতন্ত্র উৎখাত করার জন্য হোসাইন (রা.) কারবালায় গিয়েছিলেন।

আর বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এ কথাটি কতটুকু সঠিক? ইয়াজিদ কি বাতিল ছিল? ইয়াজিদ কখনো বাতিল ছিল না। তিনি কি ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো আইন চালু করেছিলেন? নাকি ইসলামিক কোনো আইনকে রহিত করেছিলেন? যার ফলে তাকে বাতিল বলে আখ্যায়িত করা হবে। তার ব্যক্তিগত আমলের ত্রুটি ছিল। আর খলিফার ব্যক্তিগত আমলের ত্রুটির কারণে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা শরিয়তে অবকাশ নেই। তাহলে বাতিলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এ ধরনের অমূলক কথা বলে নিজেদের বদ আমলের পাল্লা ভারি করার কোনো অর্থ নেই।

দুশমনের বিরুদ্ধে আপোষহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন এ ধরনের কথা কখনো প্রমাণিত হয় না। কেননা ইয়াজিদ শাসন পেয়েছেন রজব মাসে আর হোসাইন (রা.)-এর কাছে পত্র আসা শুরু হয় রমজান মাস থেকে, তাহলে এই দুই মাসে কি দূষণ করে ফেলেছিলেন? যার ফলে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আপোষহীনতার পরিচয় দিতে গিয়েছিলেন হোসাইন (রা.)। তার ব্যাপারে এ ধরনের জবাবমূলক কথা বলে তাকে সম্মান করার নামে বরং তার সম্মান ক্ষুণ্ন্ন করা হয়। কেননা যদি একথা স্বীকার করে নেয়া হয় তিনি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আপোষ করেননি তাহলে প্রশ্ন উঠে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম যারা তার সঙ্গে কারবালায় যায়নি এবং যারা তাকে যেতে বারণ করেছিলেন উনারা কি দুঃশাসনের সঙ্গে আপোষ করেছেন?

কারবালার শিক্ষা: কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা থেকে আজিমত প্রতিষ্ঠার শিক্ষা পাওয়া যায়। তাই এই শিক্ষাকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন এবং প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাবস্থায় উদগ্রীব থাকার দাবি রাখে। কিন্তু কারবালার শিক্ষার নামে সমাজে কিছু অর্থহীন বাক্কালাপ করা হয়। যেটা মূলত কারবালার শিক্ষা নয় এবং কারবালার মূল উদ্দেশ্য এর পরিপন্থী। যেমন কিছু মানুষ স্লোগান তুলে কারবালা থেকে আমরা ইসলাম জিন্দা করার চেতনা খুঁজে পাই। আবার কেউ কেউ বলে থাকে: ‘প্রত্যেকটি কারবালার পরেই মূলত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়’-এ ধরনের স্লোগান নিতান্তই অর্থহীন এবং কারবালার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বরং কারবালা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি এবং ভুল ব্যাখ্যা থেকে এ ধরনের চিন্তার জন্ম হয়।

কারবালার মূল শিক্ষা হলো আজমতের শিক্ষা। আজিমত প্রতিষ্ঠায় জীবন ত্যাগের শিক্ষা এবং কারবালার শিক্ষা রুখসতের বাহানা থেকে উঠে এসে আজমতের মতো উন্নতচরিত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কারবালার রক্তাক্ত দীনের শিক্ষা। তাই আমরা কারবালা থেকে একথা শিখতে পারি ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে পুরো ভূখণ্ডের মধ্যে আজিমতের উন্নত চরিত্র প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা নিয়ে কারবালার মর্মান্তিক অধ্যায় স্মরণ করতে পারি। এবং মুসলিম সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ুক কারবালার সেই আজিমতের শিক্ষা। কারবালার ইতিহাস দুঃখগাথা ইতিহাস। হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত চির অমর ইতিহাস।

ফমএ/এমএমএ/

ফোকাস মোহনা.কম