১১ অঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী। ছবি: সংগ্রহীত।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহঙ্কার। অসীম ত্যাগ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে বাঙালি। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এদেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন অনেকেই। চাঁদপুরের ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে ব্যাপক অবদান রাখেন মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য তরুণ ছাত্রনেতা স্বামী তাফাজ্জল হোসেন নসু চোধুরীকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) যাই। রেসকোর্স ময়দানে ছিল লাখো জনতার ঢল। অনেকের হাতে বাঁশের লাঠি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে বাঙালি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকসেনারা বাঙালি নিধনে নারকীয় হামলা শুরু করে। আমার স্বামীর সঙ্গে ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে হেঁটে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে চলে আসি।

ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার বলেন, ১০ এপ্রিল চাঁদপুর অঞ্চলে গঠিত প্রথম স্থানীয় সরকারে আমি ও আমার স্বামী অ্যাডভোকেট তফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরী যোগ দেই। ১২০৪ সাব সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জহিরুল হক পাঠানের মধুমতি কোম্পানির মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১২০৪ সাব সেক্টরের অধীন হাজীগঞ্জ অলিপুরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে হাল্কা অস্ত্র চালনা ও আত্মরক্ষার কৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ নেই। এ সময় সাথী যোদ্ধা ছিলেন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, আজিম, তরিক ও রতনসহ অনেকেই। ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জহিরুল হকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়েছে।
ডা. বদরুন নাহার চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মধ্যে একটি দিনের কথা আজও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। সেদিন ছিল সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখ। শরৎকাল শেষ হতে বেশি দেরি নেই। আশি^ন মাসের শেষ দিন বুধবার রাত ১১টা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সবাই নৌকায় ছিলাম। সংখ্যায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ক্যাপ্টেন আব্দুর রহমান। সেদিন শাহরাস্তির চিতোষী আর অ্যান্ড এম হাই স্কুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা।

তুমুল যুদ্ধের পর পাকবাহিনী অসংখ্য লাশ ফেলে রেখে ভোরে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প দখল করে আমাকে খবর দেয়। সংবাদ পাওয়া মাত্র আমি ক্যাম্পের ভেতরে যাই। আগেই খবর ছিল পাকবাহিনী চিতোষী উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে ১৫-২০ বছর বয়সী ২০/২৫ জন যুবতীকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে। গিয়ে দেখি এদের কয়েকজনের গায়ে কোনো কাপড় নেই। সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন।

মেডিক্যাল টিমের প্রধান হিসেবে চিকিৎসার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমি সেদিন বিবস্ত্র মেয়েদের দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমার বোরকা ও ওড়না দিয়ে যতটুকু সম্ভব তাদের ঢাকার চেষ্টা করেছি। পরে আশপাশের বাড়ি থেকে কাপড় এনে তাদের নৌকায় করে পানিয়ারা মেডিক্যাল ক্যাম্পে এনে সুস্থ করে তুলি। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী বলেন, আমি মধুমতি কোম্পানির চাঁদপুর অঞ্চলসহ নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ ১১টি অঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছি। ফরিদগঞ্জের শাশিয়ালী যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহত হয়েছিলেন। তার শরীরে কয়েকটি গুলি লাগে। তাকে পানিয়ারা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। অনেক চেষ্টার পরও তাকে আর বাঁচানো যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী ২০১২ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অফিসার, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুমিল্লা সদর হাসপাতাল ও চাঁদপুর সদর হাসপাতালের গাইনি কনসালট্যান্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতাল ও চাঁদপুর জেলা সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জনসহ বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ২০০৭ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে অবসর নেন। তিনি চাঁদপুরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। তার মধ্যে রয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ডায়াবেটিক সমিতি, প্রতিবন্ধী সমিতি, নারী সমিতি, সনাক পৌর উন্নয়ন কমিটি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আধুনিক ও প্রজন্ম-৭১। তিনি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সমাজসেবা অধিদপ্তর, সনাক, আমাদের ভারত মৈত্রী সমিতি, প্রতিবন্ধী সমিতি, নারী উন্নয়ন সমিতি, চাঁদপুর বিজয় মেলা থেকে কাজের স্বীকৃতি ও অবদানের জন্য বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। ডা. বদরুন নাহার চৌধুরী প্রায় ৪০ বছর যাবৎ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। তিনি বর্তমানে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা।

সৈয়দ বদরুন নাহার চৌধুরী ১৯৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ দরবেশ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মাতা সৈয়দা শামছুন নাহার গৃহিণী। চার ভাই-এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।

লিখেছেন: জালাল চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, চাঁদপুর।

ফোকাস মোহনা.কম