বিদ্যালয়, ঘরের বাইরে বা অন্য যেকোনোখানে শিশুরা যতটা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে নিজ পরিবারে। ৯৫.৮ শতাংশ শিশু নিজ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশের এক জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। শিশুরা পরিবারে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় মা-বাবা এবং অভিভাবকদের দ্বারা।
শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
৭ জুন রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ইনসিডিন বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি’ শিরোনামে জরিপটি প্রকাশ করে।
২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত মোট ১১টি জেলায় জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, কুমিল্লা ও রাঙামাটি। মোট পাঁচ হাজার ৭৪ জন শিশুর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জরিপটি চালানো হয়। এদের মধ্যে শহরের তিন হাজার ১৩৪ জন এবং গ্রামের এক হাজার ৯৪০ জন শিশু। এই জরিপে অংশ নিয়েছেন ১০৫ জন অভিভাবক।
শিশুকে শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি দেওয়া, ঝাঁকি দেওয়া, ছুড়ে ফেলা, চিমটি কাটা, টানাহেঁচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেওয়া, অতিরিক্ত শ্রম করানো এবং ভয় দেখানো।
জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তারা পরিবারের ভেতরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। আপন ঘরে ৫০ শতাংশ মেয়েশিশু এবং ৬০ শতাংশ ছেলেশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫.৩ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তারা কোনো না কোনো সময় ঘরে, বাইরে, স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬.২ শতাংশ মেয়েশিশু এবং ৯৪.৫ শতাংশ ছেলেশিশু।
৮৬.৯ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তারা নিজ ঘরে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঘরে থাকা শিশুরা জানিয়েছে, ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থার’ নামে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। আবার ৮১ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, সন্তান যদি অবাধ্য হয়, তবে তাঁরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার পক্ষে। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশু মেয়েশিশুর চেয়ে বেশি শারীরিক শাস্তি ভোগ করে। এর মধ্যে ৮৮.৪ শতাংশ ছেলেশিশু এবং ৮৪.১ শতাংশ মেয়েশিশু।
জরিপে বলা হয়েছে, ৮২ শতাংশ শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬.১ শতাংশ শিশু মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৮২ শতাংশ শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার, ২৪.১ শতাংশ শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে শিশুকে ছোট করা, আজেবাজে নামে ডাকা, ভয় দেখানো, গালাগাল করা, ধমক দেওয়া, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা করা, সামাজিকভাবে হেয় করা, অভিশাপ দেওয়া, লজ্জা দেওয়া, অবহেলা করা ইত্যাদি। এই হয়রানিগুলো শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
৬৭.১ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা ঘরের বাইরে বা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৮৪.৬ শতাংশ শিশু মানসিক হয়রানির শিকার, ৬৭.১ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার এবং ২৪.১ শতাংশ শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে ৫৫.৩ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার, ৫৫.৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার, ৩৭.৮ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে মেয়েশিশু ৩৯.৩ শতাংশ আর ছেলেশিশু ৩৬.৬ শতাংশ।
পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাড়া-মহল্লা এবং কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার শিশুদের ৬১.৭ শতাংশ বলেছে লজ্জা এবং মা-বাবা বা অভিভাবকদের ভয়ের কারণে তারা মুখ খোলেনি। ৫২.৭ শতাংশ বলেছে, তারা ওই সময় বুঝতে পারেনি তাদের ওপর যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। আর ৩০.১ শতাংশ বলেছে, অপরাধী তাদের হুমকি দেওয়ায় তারা চুপ থেকেছে।
৬২.১ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু বলেছে, শুধু প্রতিবন্ধী হওয়ায় তারা পরিবারে ও সমাজে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলেশিশু ৭৮.৬ শতাংশ আর মেয়েশিশু ৫৫.২ শতাংশ।
জরিপে আরো দেখা গেছে, ৩৪ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা পর্নোগ্রাফি দেখেছে। আর ৭৫.১ শতাংশ শিশু বলেছে, তাদের মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন রয়েছে এবং তারাও পর্নোগ্রাফি দেখেছে। ২৬ শতাংশ মেয়েশিশু বলেছে, তারা আত্মীয়ের সঙ্গে পর্নোগ্রাফি দেখেছে। ১৪.৪ শতাংশ মেয়েশিশু বলেছে, তারা অনাত্মীয়দের সঙ্গে পর্নোগ্রাফি দেখেছে। শিশুদের এভাবে পর্নোগ্রাফি দেখার মাধ্যমে তাদের মধ্যে যৌন নির্যাতনের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
জরিপের সুপারিশে বলা হয়েছে, নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। শিশুর প্রতি যেকোনো ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুকে সঙ্গে নিয়ে অনিরাপদ পারিবারিক অভিবাসন থামাতে হবে। শিশুর প্রতি যে নির্যাতন চালাবে তাকে প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় আনতে হবে। কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
ফম/এমএমএ/