।। অজয় কুমার ভৌমিক।। ১. আবদুর রব যৌবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশে আসেন। সে সময় থেকেই তার সাথে আমাদের সুসম্পর্ক হয়। ১৯৭০ সাল থেকে সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ও গুরুত্বপূর্ণ সভায় তাঁর উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। তার মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের যে স্পৃহা আমি সে সময় দেখছি, তা বিস্ময়কর। আমার বিশ্বাস ছিল যদি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তবে সুবেদার রব মনেপ্রাণে আমাদের সাথে থাকবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তার সাথে আমি ফ্লাইট লে. এবি সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে সুবেদার রব আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমরা একসাথে ট্রেনিংয়ের জন্যে ভারতে যাই। সেখান থেকেই সুবেদার রব মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ এবং ট্রেনিংয়ে যথেষ্ঠ সহযোগিতা করেন। যতদূর মনে পড়ে, তিনি একটি বাহিনীও গঠন করেন। চাঁদপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে সুবেদার আবদুর রব ছিলেন আতঙ্কের নাম। কৌশলে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার তার যে সক্ষমতা আমি দেখেছি, সেটি বিরল। বলা যায়, দেশপ্রেমের এক অনন্য সাক্ষী হিসেবে আমি তাকে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল আমি সুবেদার রবের কাছেই পেয়েছি।
২. সুবেদার আবদুর রব ব্যক্তি হিসেবে খুবই সজ্জন ছিলেন। তার সততা ও সাহসিকতা ছিল অনন্য। পূর্বেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানিদের জন্যে আতঙ্ক। তার নাম শুনলে হানাদাররা মারাত্মক ভয় পেত। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিক ভূমিকার জন্যে যুদ্ধের পরেও সুবেদার রবের নামটি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ছিল। যুদ্ধের সময় আমরা অর্থলোভী অনেককেই দেখেছি। নানান বিষয়ের প্রতি অনেকের লোভ ছিল। কিন্তু সুবেদার আবদুর রব যদি তেমন কেউ হতেন, তবে তিনিই অনেক কিছুর মালিক হতে পারতেন। তিনি তা করেননি। তিনি দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছেন সামনে থেকে। এমনকি যারা লোভী ছিলেন যুদ্ধের পরেও তিনি তাদের কাউকে শত্রু মনে করে আঘাত করেননি। সহনশীল ভদ্রলোক হিসেবে তাকে আমি সবসময় দেখেছি।
৩. ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রার যে ক্যাম্পটি ছিল, বলতে গেলে সে ক্যাম্পের নেতৃত্ব ছিল সুবেদার রবের ওপর। বালিথুবা, চান্দ্রা, লক্ষ্মীপুরের ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের সুবেদার রবই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার নেতৃত্বেই এই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। যদিও এ দলের নেতৃত্ব ছিল শহিদ জাবেদ সাহেবের ওপর। কিন্তু জাবেদ সাহেব সকল কাজেই সুবেদার রবকে সামনে রাখতেন। অর্থাৎ সুবেদার রবের সম্মুখ নেতৃত্বেই ওই অঞ্চলে যুদ্ধ হতো।
৪. সুবেদার রব খুব সাহসী সৈনিক ছিলেন। তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। দেশ স্বাধীনের পরেও আমাদের সুসম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল। তিনি আমার কাছে নিয়মিতই আসতেন। সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। তার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। আর্থিক সচ্ছলতার জন্যে তিনি ঠিকাদারি কাজে যুক্ত হন। আমি তাকে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান কাদের মাস্টার সাহেবের কাছে নিয়ে যাই। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। বলি, সুবেদার রব দেশের জন্য নিরলস কাজ করেছেন। এমন মহান ব্যক্তির জন্যে যদি কিছু করা যায় তাহলে উপকার হয়। তখন চেয়ারম্যান সাহেব আমার অনুরোধ রাখেন। তাকে ঠিকাদারি কাজের সাথে যুক্ত করেন। যুদ্ধের পর বর্তমান শিল্পকলার পাশে একটা ভবনে মুক্তিযোদ্ধারা সময় কাটাতেন। সুবেদার আবদুর রবও সেখানে আসতেন। সেখানেও আমরা বসে কথাবার্তা বলতাম। তার এই স্মৃতিগুলো আমার চোখে ভাসে।
৫. মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের কথা অনেকেই বলে এবং দাবি করে। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক হিসেবে আমি যাদেরকে মনে করি, সুবেদার আবদুর রব তাদের অন্যতম। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের নায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান মানুষ। তার মতো মানুষের কথা প্রজন্মকে জানানো উচিত। তাহলেই আরো দেশপ্রেমিক মানুষ গড়ে উঠবে।
অজয় কুমার ভৌমিক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সাবেক
সম্পাদক, চাঁদপুর শিল্পকলা একাডেমি।