স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের প্রেরণায় আগামীর পথচলা

প্রতিকী ছবি।

।। শেহজাদ মুনীম।। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ হলো এ বছর। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ যা বন্যা, খরা ও দুর্ভিক্ষ দিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি ছিল। একসময় এই দেশকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। অবশ্য সেই ভাবমূর্তি থেকে বের হয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার। আজ আমাদের জিডিপির আকার ৪০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলার। সামগ্রিকভাবে আমাদের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে।

অতিদরিদ্রতা কমেছে, বেড়েছে নারীর ক্ষমতায়ন ও উপার্জনে অংশগ্রহণ। তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতে উদ্ভাবনের ফলে বেড়েছে প্রসার। মানুষের শিক্ষার হার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সূচক-সব কিছুই এখন ঊর্ধ্বমুখী। ধারণা করা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই গতি অব্যাহত থাকলে, শিগগিরই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকব। তবে এই অর্জনেই আমাদের সন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকলে চলবে না।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের হাতে আর সময় আছে মাত্র ২০ বছর। দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সঠিক পথে ধাবিত করতে পারছি কি না তা নিয়েই এখন কাজ করতে হবে।

আমরা যারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রজন্ম, তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত চেতনা কাজ করে; ভালো কিছু করার, নতুন কিছু করার এবং অসীম সাহসের সঙ্গে প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু এই চেতনাকে উজ্জীবিত রাখতে আমরা এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মকে কি যথেষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারছি কি না, এটিও ভাবনার বিষয়। ব্যক্তিগত একটা ঘটনা দিয়ে যদি বলি তবে হয়তো তা বুঝতে সুবিধা হবে। চাকরি সূত্রে নিউজিল্যান্ডে যখন কাজ করতে যাই, ওখানকার সিইও আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার এখানে কেমন লাগে? সুন্দর একটা দেশ, ভালোই লাগছে, বলা বাহুল্য তাই সেটাই বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘বেশি ভালো লেগে গেলে কিন্তু আর দেশে ফিরতে ইচ্ছা করবে না।’ সেদিনের তরুণ আমি তাঁকে জোর গলায় বলেছিলাম, ‘আমার পূর্বসূরিরা যুদ্ধ করেছে আমাকে একটি স্বাধীন দেশ দেওয়ার জন্য। আমি যেখানেই যাই, যা-ই করি না কেন, আমার দেশে আমি ফিরবোই। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজের সূত্রে অনেক দেশে ঘুরেছি, থেকেছি, কাজ শিখেছি এবং করেছি। আর যখন সময় হয়েছে, আমি আমার দেশেই ফিরে এসেছি। প্রায় এক দশক ধরে এখানেই বসে আমার দেশের মানুষকে নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে তা সম্ভব? যেখানে আমাদের নতুন প্রজন্ম সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকে একটি সুযোগের—যেকোনোভাবেই হোক বিদেশে পড়তে বা চাকরি কিংবা নাগরিকত্ব নিতে; সেখানে আমরা কেন ফিরে আসি? এর উত্তর একটাই, যেই দেশ আমাদের এত কিছু দিয়েছে, সেই দেশকে আমাদের জায়গা থেকে প্রতিদান দিতে, এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে যেন এই বিদেশমুখী মেধার ঢলকে বাংলাদেশেই কাজে লাগাতে পারি। এর পরও যাঁরা বিদেশে থেকে যাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু প্রবাসে বাংলদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। দেশের যেকোনো অর্জনই তাঁদের অনুপ্রাণিত করে এবং অনেক সময় তাঁরা এই উন্নয়নের যাত্রায় যোগ দিতেও আগ্রহী থাকেন। আমাদের উচিত আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ করে দেওয়া।

বর্তমানে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। আর এই বিশাল খাত তৈরিতে প্রথমদিককার যে বহুজাতিক বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে কাজ শুরু করে, তাদের অবদানের কথা না বললেই নয়। একসময়ের গ্রিনলেজ এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের থেকে হাতেখড়ি নেওয়া মানুষই পরবর্তী সময়ে স্বদেশি ব্যাংকগুলোকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছে। বিএটি, আইসিআই, ইউনিলিভার, নেসলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল কর্মী বাহিনীর সক্ষমতা তৈরিতে যে অবদান রেখেছে, তারাই পরবর্তী সময়ে একই রকম স্বদেশি বিপণন ও বাণিজ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এর মধ্যে দেশীয় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও ব্যবসা করছে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বহুজাতিকের মতো শত বছর সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য কী করছে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আর এসব কিছুর জন্যই আমাদের এখন প্রয়োজন তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া—দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও মেধার বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা; প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সুশাসন স্থাপন ও নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং একই ধরনের খাতগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষা, গবেষণা ও অনুশীলনের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা। এগুলো নিয়ে যদি আমরা দ্রুত কাজ করতে পারি, তাহলে আমরা ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’ থেকে রক্ষা পাব। এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রচলনে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ের উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবন প্রয়োজন এবং এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের পেছনে অনেক কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) পদক্ষেপ রয়েছে। যেমন—ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এনডাওমেন্ট ফান্ড দিয়ে গবেষণায় সহায়তা করা, নিজের দেশে কোন প্রেক্ষাপটে কোনটি ভালো কাজ করবে, তার চাহিদা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া। চাকরিজীবী বা উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন রকম ফেলোশিপ বা ট্রেনিং কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে কাজ করে মিথস্ক্রিয়া এবং অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞানের আদান-প্রদান করা, কেস স্টাডি এবং সাকসেস স্টোরি প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী করে তোলা-এ রকম অনেক ধরনের কাজ হয়। আমাদের দেশেও এ ধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হয়েছে। এর ফলে মেধার যেমন সঠিক মূল্যায়ন হবে, তেমনি সঠিক সময়ে সব সুযোগ কাজে লাগানো যাবে।

একাত্তরে ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’-এমন মন্ত্রে যুদ্ধ করেছেন আমাদের তরুণ-যুবারা। আমার মতে, এখন সময় এসেছে আমাদের এ ধরনের আরেকটি যুদ্ধে যাওয়ার, অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল হওয়ার যুদ্ধে। মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণার পরে এবং পরবর্তী সময়ে করোনা মহামারির ফলে আমাদের দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দাতা সংস্থা ও বিদেশি সরকারের অনুদান কমে আসছে প্রতিনিয়ত। হয়তো টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় আমরা পৌঁছতে পারব, কিন্তু নিজেদের পরনির্ভশীলতা সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠে নিজ দেশেই বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই একটি ইকোসিস্টেম তৈরিতে করপোরেট বা বেসরকারি খাতকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশ স্বাধীন করতে যেমন সঠিক নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল, তেমনি দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও আর্থিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত রাখতে দরকার সঠিক স্থানে সঠিক দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের। এর সব কিছু হয়তো সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, তবে যেটা সরকারের পক্ষ থেকে লাগবে, তা হলো ব্যবসাবান্ধব পলিসি নিশ্চিত করা।

এর সঙ্গে দরকার সুচিন্তিত অবকাঠামো তৈরি, যার ফলে শহর বিকেন্দ্রীকরণ হবে। সব জেলায় সমভাবে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের এবং কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা থাকবে। আমাদের যে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে তাদের দক্ষ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করতে ভৌগোলিকভাবে পিছিয়ে থাকা বা দুর্যোগপূর্ণ এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ উপযোগী শিল্প ও বাণিজ্য এলাকা নির্ধারণ করার কথাও ভেবে দেখা যেতে পারে।

সর্বোপরি ‘আমি বাংলাদেশি’—এই পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করা শিখতে হবে আমাদের। যেসব সমস্যা নিয়ে আমরা অনুযোগ করি, সেগুলো যদি আমরা সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে পারি, তবেই আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন। এর জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, সুগম করতে হবে আগামীর প্রজন্মের জন্য উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথ। তাদের কাজের ক্ষেত্র এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের ৫০ বছরের জীবনে সামগ্রিকভাবে বেসরকারি খাতের যে অবদান আছে সেগুলোও যথাযথ স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রণোদনা, মর্যাদা, উৎসাহ, ছাড়—যে ক্ষেত্রে যেটা প্রযোজ্য সেটা দিয়েও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে; যাতে এর পেছনের মানুষেরা বাংলাদেশি পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে পারে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘মেড ফর বাংলাদেশ’—এই ধারণাটা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে আত্মস্থ না করলে ‘আই এম বাংলাদেশ’ পরিচয়টাই দুর্বল হয়ে থাকবে। পঞ্চাশের আনন্দকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে আগামী পঞ্চাশের জন্য কী রেখে যাচ্ছি, সেটা নিয়েই আমাদের এখন কাজ করার পালা।

লেখক : ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সাবেক সভাপতি, ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।

সংগ্রহীত।

ফোকাস মোহনা.কম