সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও বাংলাদেশের ফুটবল

ফাইল ছবি।

।। ইকরামউজ্জমান।। উপমহাদেশে ক্লাব ফুটবল ঘিরে ১৩০ বছরেরও আগে যে আবেগ আর উন্মাদনা ছিল তা কখনো জাতীয় দলের ফুটবলে প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম হয় দুটি স্বাধীন দেশ ভারত ও পাকিস্তান। আমাদের পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান নামের দেশটির একটি প্রদেশ। ’৪৭-এর দেশ ভাগের পরও ফুটবল চত্বরে দেখা গেছে সেই একই মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি।

দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে শূন্য থেকে পূর্ণ করতে হবে। আবার দেখা গেল সেই পুরনো ক্লাবপ্রীতি। ফুটবলে ক্লাবই সব। এই মানসিকতায় প্রথম থেকেই জাতীয় দল গুরুত্বহীন। জাতীয় দল নিয়ে যেভাবে পরিকল্পনামাফিক কাজ করা উচিত ছিল তা হয়নি। জাতীয় দল থেকে ক্লাব বড়। ক্লাবে ক্লাবে ফুটবলের মর্যাদা নিয়ে রেষারেষি। এর উত্তাপ ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে।

দেশে ফুটবলের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় দল কিন্তু প্রথম থেকেই কম গুরুত্ব পেয়েছে। জাতীয় দলের বিষয়টি সব সময় জোড়াতালি দিয়ে সামাল দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই ছিল না জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা। জাতীয় ফুটবল দল শুরু থেকেই তাই ধুঁকেছে। খাবি খেয়েছে। নিচের দিকে ছুটেছে। উপমহাদেশে যারা একসময় এ দেশের মাঠের ফুটবলে অনেক পেছনে ছিল তারা সবাই টপকে সামনে চলে গেছে। বিপত্সংকেত বোঝার পরও ফুটবল কর্মকর্তারা এটিকে আমলে নেননি।

খেলোয়াড়রা সব সময় ক্লাব ফুটবল থেকে লাভবান হয়েছেন কিন্তু মাঠে জাতীয় ফুটবল দল সব সময় হেরেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ১৯৯২-৯৩ সালে ফিফার র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৬-তে, এখন পেছনে ছুটতে ছুটতে ১৮৯-তে। তখন ভারতের র্যাংকিং কত ছিল? এখন ভারতের র্যাংকিং ১০২।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শ্রীলঙ্কা ছাড়া (২০৭), ছোট ভুটান পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপরে। বাংলাদেশকে তো আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে এখন অনেক কিছুই ভাবতে হয়। মুখে আত্মবিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই কঠিন বাস্তবতায় মাঠের লড়াইয়ে। ১৩তম সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে একমাত্র শ্রীলঙ্কা ছাড়া বাকি তিনটি দেশ প্রতিটি র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ওপরে। রোগ সারানোর জন্য বারবার চিকিৎসক বদলানো তো সমস্যার সমাধান নয়। এভাবে তো ফুটবল ক্রনিক রোগ থেকে মুক্তি পাবে না। ২০০৩ সালের পর এই ট্রফি আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। বিগত চার আসরে সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে আসতে পারেনি। এবার রাউন্ড রবিন লিগের খেলা। সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জনকারী দুটি দল ১৬ অক্টোবর ফাইনাল খেলবে। সাফ ফুটবলে সবচেয়ে সফল দল ভারত। সাতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

এখন সাফ ট্রফি আছে স্বাগতিক মালদ্বীপের ঘরে। ভারত সেই পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়েই লড়ছে। সাফ ফুটবলের বিগত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশ ফাইনালে খেলতে হলে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে যেতে হবে। গত আসরগুলোতে বাংলাদেশ যা পারেনি—এবার মাঠে তা বাস্তবায়িত করতে পারলে অনেক কিছু সম্ভব। ফুটবল দেখতে খুব সহজ হলেও কঠিন খেলা। এখানে আবেগ আর আত্মবিশ্বাস অন্য রকম। ভারত সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের। কিন্তু নেপাল ও মালদ্বীপ। ভারতের সঙ্গে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে প্রথম ম্যাচে ড্র এবং ফিরতি ম্যাচে ২-০ গোলে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ। শুধু কাগজে নয়, মাঠের দলগত শক্তিতেও বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে ভারত।

বাংলাদেশের জন্য যেটি চ্যালেঞ্জ, সেটি হলো নেপাল এবং স্বাগতিক মালদ্বীপকে পেছনে ফেলা। পণ্ডিতরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা উভয় দলের বিপক্ষে পঞ্চাশ, পঞ্চাশ। সাহসের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস, নিজের সামর্থ্যটা শতভাগ উজাড় করে দেশের জন্য খেললে উঁচু হার্ডলস অতিক্রম করা সম্ভব। জয়ের ক্ষুধা আর ইতিবাচক মানসিকতায় কোনো বিকল্প নেই। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ তো দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবল যজ্ঞ। সবচেয়ে বড় মর্যাদার লড়াই। দেড় শ কোটিরও বেশি মানুষের প্রতিনিধিদের ফুটবল যুদ্ধ। ১ থেকে ১৬ অক্টোবর সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে মালদ্বীপে। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ অস্কার ব্রুজোনের তত্ত্বাবধানে ২৩ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় দল। দেশের ফুটবলে সেরা খেলোয়াড়দের নিয়েই দল গঠন করা হয়েছে।

এবার সেই পুরনো ট্র্যাডিশন অনুযায়ী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে জাতীয় দলের হেড কোচ সরিয়ে দিয়ে নতুন কোচ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোচের বিষয়টা হলো রেজাল্ট না দিতে পারলে বিদায় নিতে হবে। জিমি ডের সরতে হয়েছে-কেননা তিনি তো জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর পরিবর্তে স্প্যানিশ কোচ বসুন্ধরা কিংসের অস্কার ব্রুজোনকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্রুজোন গত দুই মৌসুমে ক্লাব দলকে দুটি লিগ শিরোপা ছাড়াও আরো তিনটি শিরোপা জিতিয়ে দেওয়ার কারিগর। স্প্যানিশ এই কোচের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, তিনি সব খেলোয়াড়কে চেনেন এবং বোঝেন।

তা ছাড়া জাতীয় দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় বসুন্ধরা কিংসের দলের সঙ্গে গত তিন বছর ধরে কাজ করেছেন। কোচ ব্রুজোন দলটা গুছিয়ে নিতে পেরেছেন সহজেই অল্প সময়ে। তবে বাংলাদেশ দল তাঁর অধীনে দুই বছর পর এবার আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলবে। রক্ষণাত্মক ফুটবলের পরিবর্তে। ব্রুজোনের কথা হলো আমি চিত্তাকর্ষক ফুটবল উপহার দিতে চাই। আমি নিজে জাদুকর নই, তবে যোদ্ধা। খেলোয়াড়দের প্রতি আমার আস্থা আছে। তারা আক্রমণাত্মক ফুটবল ভালো খেলবে। ওপরে উঠবে আবার নিচে নামবে। সবাই গোল করার চেষ্টা করবে। যাঁরা ভাবেন গোল করার সামর্থ্যের অভাব আছে, তাঁরা এবার দেখবেন অন্য কিছু। কোচ মনে করেন জাতীয় দল আশাব্যঞ্জক ফুটবল খেলবে। সাবেক খেলোয়াড় এবং কোচরা বলেছেন, ব্রুজোনের নিয়োগটা ঠিক আছে। তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়, যাঁরা তাঁর চিন্তা-ভাবনা এবং পরিকল্পনায় অভ্যস্ত। অন্য যাঁরা দলে আছেন তাঁদের পক্ষে নতুন কৌশলে ফুটবল খেলতে অসুবিধা হবে না।

বাংলাদেশের ফুটবল সংস্কৃতিতে কোচ পরিবর্তনটা একটু বেশি। গত ১৩ বছরে ২০ জন বিদেশি এবং দেশি কোচ দায়িত্ব পালন করেছেন। সব সময় বলা হয়েছে, কোচ রেজাল্ট দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর এই অভিযোগ অবশ্য বাস্তবতার বাইরে নয়। বাংলাদেশের ফুটবল সংস্কৃতিতে কোচকে নিয়ে প্রথম অনেক উদ্যম আর লাফালাফি। এরপর কিছুদিন যেতেই অন্য সুরে কথাবার্তা। জিমি ডে নিয়ে একসময়ের উৎসাহের বেলুন কিভাবে বাতাসহীন হয়েছে এটা সচেতন মহল দেখেছেন। নতুন কোচের জন্য বড় সুবিধা হলো তিনি শুধু সাফ ফুটবলের জন্য।

এখানে রেজাল্ট দিতে পারলে কী হবে জানি না। স্প্যানিশ কোচ কিন্তু কখনো কোনো দেশের জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। তাঁর জন্য এটি অনেক বড় সুযোগ। ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বিশ্বাস করেন ব্রুজোনের নেতৃত্বে খেলোয়াড়রা ভালো করবেন। তিনি আরো বলেছেন, শিরোপা জিতলে খেলোয়াড়দের এমন পুরস্কার দেবেন, যেটি তাঁরা ভাবতেও পারছেন না। গুডলাক-বাংলাদেশ দল।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

সৌজন্যে: দৈনিক কালের কন্ঠ।

ফোকাস মোহনা.কম