শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও চাঁদপুরের চাঁদকন্যা জোহরা তাজউদ্দীন

আশিক বিন রহিম।। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। একই বছরের ৩ নভেম্বর কারাগারের হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা- তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে।

এতে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চরম নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি হয়। দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকেই তখন জেলে বন্দী অথবা পলাতক। সেই দুঃসময়ে দলটির নেতৃত্ব অর্পিত হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদের সহধর্মিণী এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের উপর। ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে এক ঘরোয়া বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে চাঁদপুরের এই চাঁদকন্যাকে আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক করা হয়।

দলের সেই দুর্দিনে, রাজনীতিক বাধা-নিষেধের মধ্যেও জোহরা তাজউদ্দীন গোটা দেশ চষে বেড়িয়ে আওয়ামী লীগে প্রাণ সঞ্চার করে নেতাকর্মীদের উজ্জিবিত করেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

এদিকে পিতা-মাতাসহ পরিবারের সকল সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের অসহনীয় দুঃখবোধ-যন্ত্রণা বিদেশের মাটিতেই বয়ে নিজেদের প্রস্তুত করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরমধ্যে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। অবশেষে দেশের পরিস্তিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। তারা অকৃপণ ভালোবাসার প্রাণঢালা অভ্যর্থনায় বরণ করে নেন প্রিয় নেত্রীকে।

এরপর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার হাতে দলের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে নিজের আদর্শ এবং সততার পরিচয় দেন চাঁদপুরের গর্বিত সন্তান জোহরা তাজউদ্দীন। রাজনীতিক প্রাজ্ঞজনদের মন্তব্য জোহরা তাজউদ্দীন দলটির শীর্ষ পদে থেকে সততা এবং আদর্শের পরিচয় না দিয়ে দলের সাথে বেইমানি করলে বর্তমান রাজনীতিক ইতিহাস হয়তো ভিন্নভাবে লিখতে হতো। আওয়ামী লীগের চমর দুঃসময়ের এ কাণ্ডারি পরবর্তীতে আমৃত্যু দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে সম্মানিত ছিলেন।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ১৯৩২ সালের ২৪ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ-শাহরাস্তি উপজেলার ওয়ারুক বাজার। পিতা সৈয়দ সেরাজুল হক ঢাকা কলেজর অধ্যাপক ছিলেন। একটি সূত্রে জানা যায়, তার বাবা দীর্ঘদিন হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি ১০ নং টামটা ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রশাসক ছিলেন।১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির বিয়ে হয়। তাঁদের চার ছেলে মেয়ের মধ্যে সিমিন হোসেন রিমি সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। একমাত্র ছেলে তানজিম আহমদ সোহেল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ষাটের দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় রাজবন্দি সাহায্য কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে নারী মুক্তি আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতিও। এছাড়াও এশীয় গণসংহতি পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। এই পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মৃত্যুরবণ করেন।

তথ্যঋণ :
১| ‘সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে উত্তরণ’ মালেকা বেগম, দৈনিক প্রথম আলো, ২০১৯-১০-০৬।
২| জোহরা তাজউদ্দীনের মেয়ে শারমিন আহমদের লেখা ‘অনন্য জুটি তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন’
৩| ‘জোহরা তাজউদ্দিন: দুঃসময়ের একজন কাণ্ডারী’ বাংলানিউজ, ২০ ডিসেম্বর ২০, ২০১৯।

লেখক পরিচিতি : আশিক বিন রহিম, সাহিত্য ও সংবাদকর্মী, প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক : সাহিত্য মঞ্চ, সদস্য সচিব : সামাজিক সংগঠন আপন, জেলা প্রতিনিধি দৈনিক বানিজ্য প্রতিদিন।

ফোকাস মোহনা.কম