শিক্ষকদের হয়রানি করা অধ্যক্ষ রতন কুমারের যত কান্ড

রতন কুমার মজুমদার। ছবি: সংগ্রহীত।

চাঁদপুর: পেশায় শিক্ষক হলেও তার কর্মকান্ডছিলো উস্কানিমূলক। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও শিক্ষার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরী করতে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন সব সময়। তার এমন উদ্দেশ্যে প্রনোদিত লেখালেখির জন্য মোচলেকাও দিতে হয়েছে। তিনি হলেন চাঁদপুর শহরের পুরাণ বাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। সবাই তাকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির অত্যন্ত কাছের লোক মনে করতেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি সবচাইতে বেশী হয়রানি করেছেন শিক্ষকদেরকে।

বিগত ১৬ বছর দীপু মনি চাঁদপুরের সাংসদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও সর্বশেষ সমাজকল্যাণমন্ত্রী থাকাকলীন সময়ে রতন কুমার নানা কৌশলে তার কাছে চলে আসেন। এরপর থেকে হয়ে উঠেন দীপু মনির উপদেষ্টা। সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর তার দৌরাত্ম্য চরম সীমা অতিক্রম করে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করলে আত্মগোপনে চলে যান রতন। পালিয়ে গেলেও জনরোষ থেকে রক্ষা পায়নি চাঁদপুর শহরের আদালত পাড়ার তার বসতবাড়িটি।

চাঁদপুর পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজের দীর্ঘ মেয়াদে অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। তার হয়রানির শিকার হয়েছেন স্থানীয় বহু শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু না হয়েও অঘোষিতভাবে রতন কুমার মজুমদার সব বদলি, নিয়োগসহ মন্ত্রণালয়ের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। আওয়ামী লীগের সময়ে ডা. দীপু মনি যখন শিক্ষামন্ত্রী তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ বিসিএস কর্মকর্তা এমনকি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে শুরু করে অনেক কর্মকর্তা নিজেদের পদোন্নতি, সুবিধাজনক স্থানে বদলিসহ নানা কাজের তদ্বিরে তারা চাঁদপুর এসে রতনের দ্বারস্থ হতেন।

আর এসব অনৈতিক কাজের জন্য তিনি কামিয়েছেন বিশাল পরিমাণ টাকা-এমনটি ভুক্তভোগী শিক্ষকদের কাছে শুনেছেন বলে জানালেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার।

তিনি আরও জানান, সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপ মনির সময়ে রতন কুমার মজুমদার পুরো শিক্ষা বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রতন মজুমদারের ভয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা তটস্থ থাকতেন।

তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মাথায় খোদ চাঁদপুরে হাসান আলী ও মাতৃপীঠ সরকারি হাইস্কুলের দশ জন অভিজ্ঞ শিক্ষককে দেশের নানা দুর্গম এলাকায় তাৎক্ষণিক বদলি করেন। কোন প্রকার অভিযোগ না থাকলেও জামায়াত-বিএনপি তকমা লাগিয়ে এদের স্ট্যান্ড রিলিজ করানো হয় তখন।

যার পেছনে কলকাঠি নাড়েন এই রতন কুমার মজুমদার এমনটি জানালেন চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে খাগড়াছড়িতে স্ট্যান্ড রিলিজ হওয়া ইংরেজি শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান।

তিনি বলেন, ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান কারিকুলামের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখায় আমাকে খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় তাৎক্ষণিক বদলি করেন। যার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখেন এই রতন কুমার মজুমদার।

শুধুমাত্র শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, নানা ধর্মীয় উস্কানিমূলক লেখা পোস্ট দিতেন তার ফেসুবকে। তার সাথে দেশের বড় বড় পদের লোকদের সাথে সখ্যতা আছে এমন কথা জানান দিতে সামাজিকযোগযোগ মাধ্যমে। তবে ২০২০ সালে তিনি হেফাজত ইসলাম নেতা বাবু নগরীকে নিয়ে ফেসবুকে লেখার কারণে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই দলের নেতারা। এক পর্যায়ে শহরের শপথ চত্বরে তার বিরুদ্ধে কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দেন নেতারা।

এমন পরিস্থিতিতে তার ওই লেখা মুছেদিতে এবং প্রকাশ্যে হেফাজত নেতাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য মধ্যস্থতার দায়িত্ব নেন দীপু মনির বড় ভাই ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু। পরে সদরের রাজরাজেশ^র ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান হজরত আলী ব্যাপারীর উদ্যোগে হেফজাত নেতাদের সাথে নিয়ে দীপু মনির কদমতলাস্থ বাসায় বৈঠক হয়। সেখানে রতন কুমার মজুমদার মুচলেকা দেন এবং আর এই ধরণর উস্কানিমূলক কথা লিখবেন বলে অঙ্গীকার করেন।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে কটুক্তির প্রতিবাদে অধ্যক্ষ রতন মজুমদারকে প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করে পুরাণ বাজার কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময় গত ৩ আগস্ট রতন কুমার মজুমদার দীপু মনির হয়ে পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে শহরের হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। সেখানে তার সাথে দীপু মনির সুবিধাভোগী অন্য পেশার লোকদেরকেও জড়ো করেন। এই কর্মসূচিও তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ওই মানববন্ধনের ছবি ও ফুটেজ ধারণ করে শিক্ষার্থীরা।

এদিকে রতন কুমার মজুমদার আত্মগোপনে যাওয়ার পর ৭ আগস্ট থেকে সেই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মো. শোয়ায়েব। তিনি ওই কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।

ফম/এমএমএ/

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | ফোকাস মোহনা.কম