নানা বিতর্কের পর সংসদে পাস হলো নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের বিলটি। বৃহস্পতিবার কিছু সংশোধনীসহ ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করলে দীর্ঘ প্রায় তিন ঘণ্টা বিতর্কের পর এটা সংসদে গৃহীত হয়।
বিলটি সংসদে পাসের পর এখন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাতে সম্মতি দিলেই তা আইনে পরিণত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, আজকালের মধ্যেই বিলটিতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করবেন, এরপর গেজেট প্রকাশ হবে। এই আইনের অধীনেই কয়েক দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন।
এদিকে, বিলের উপর আনা কিছু সংশোধনী সংসদে গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির করা সুপারিশ। বাকিগুলো হয়েছে গতকাল সংসদে কয়েক জন সংসদ সদস্যের আনা প্রস্তাবের ভিত্তিতে। বিলের শিরোনামেই পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাশের জন্য আইনমন্ত্রীর উত্থাপিত বিলের শিরোনাম ছিল, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’। সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে এখন নাম হবে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’।
বিলে বলা ছিল, ‘রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন।’ এর মধ্যে বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে দুই জনকে মনোনয়ন দেবেন রাষ্ট্রপতি। এই দুই জনের মধ্যে একজন নারীকে রাখার প্রস্তাব দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার প্রস্তাবটি গৃহীত ইসি গঠনে সার্চ কমিটি হওয়ায় কমিটিতে রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুই জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে বাধ্যতামূলক একজন নারীকে রাখার বিধান যুক্ত করা হয়েছে পাস হওয়া বিলে।
উত্থাপিত বিলে বলা ছিল, ‘সার্চ কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাব করবে।’ এক্ষেত্রে সংশোধনী এনে ‘১৫ কার্যদিবস’ করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির করা দুটি সুপারিশও গৃহীত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্তে দুটি পরিবর্তন আনার সুপারিশ করে স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বুধবার সংসদে বিলটির ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সংসদে উত্থাপিত বিলে আরও বলা হয়েছে, সিইসি ও কমিশনার হতে সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদে নূন্যতম ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই ধারায় সংশোধনী এনে সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও পেশায়’ যুক্ত করার সুপারিশ করে স্থায়ী কমিটি। এছাড়া অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বিলের ৬(ঘ) ধারায়ও স্হায়ী কমিটি কিছুটা পরিবর্তনের সুপারিশ করে।
এ ধারায় বলা হয়েছিল, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে নূন্যতম দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সিইসি ও কমিশনার হওয়া যাবে না। এখানে দুই বছরের কারাদণ্ড উঠিয়ে শুধু ‘কারাদণ্ড’ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বিলের ওপর বিভিন্ন শব্দ ও ছোটখাট কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সংসদ সদস্যদের ৬৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ২২টি আইনমন্ত্রী গ্রহণ করেন, যা সংসদে কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়।
সংশোধনীগুলো গ্রহণের সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এতগুলো সংশোধনী আগে কখনো গ্রহণ করা হয়নি।’ স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার অনেক দিন পর এমপিরা আমাকে পানি খাইয়ে দিয়েছেন।’
পাসকৃত বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দুই জন করে মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুই জন বিশিষ্ট নাগরিক (যাদের মধ্যে একজন নারী থাকবেন)। সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এছাড়া, পাসকৃত বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো- বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, নূন্যতম বয়স হতে হবে ৫০ বছর এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বিচার বিভাগীয়, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
আর ছয়টি অযোগ্যতা হলো- আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে, দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবু্ন্যালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইবু্ন্যালস) অর্ডার-১৯৭২-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।
নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের খসড়া গত ১৭ জানুয়ারি অনুমোদন দেয় মন্ত্রীসভা। এরপর ২৩ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ সংসদে উত্থাপন করেন। সবমিলিয়ে ১০ দিনের মধ্যে বিলটি পাশের প্রক্রিয়া শেষ হলো।
পাসকৃত বিলে কাউকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়নি জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, এই আইনে লিগ্যাল কাভারেজ দেওয়া হয়েছে। এই আইনের মধ্যে কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকে প্রটেকশন দেয়া হয়নি।-খবর বাংলাদেশ জার্নাল।
ফম/এমএমএ/