।। এস ডি সুব্রত।। প্রেম বিরহ নিয়ে কৌতুহল ও রহস্যের শেষ নেই। সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের নির্দিষ্ট একজনের প্রতি পূর্ণ আসক্তি ই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘”সবকিছু ত্যাগ করে যে ভালবাসা তাই প্রেম।” বিপরীত সত্তাকে মহার্ঘ অনুভব করে আপন সত্তাকে সমর্পণের আকুতিই মানব মানবীর প্রেমের প্রথম ও প্রধান নির্দেশক । ভালবাসা যদি হয় হিমালয়ের পাদদেশ তবে প্রেম হল তার চূড়া। ভালবাসা হল ট্রেনের কামড়ায় মতো যেখানে একসাথে অনেকেই থাকতে পারে।আর প্রেম হচ্ছে রিক্সায় চড়ার মতো যেখানে থাকবে শুধু দুজন নরনারী ।ভালবাসা যখন হয়ে উঠে অস্থিমজ্জা সহ সেটাই তখন সত্যিকারের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। প্রায় সকল কবি লেখক তাদের কলমে চরমতম অনুভূতির কলায় শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন প্রেম এক অনন্য সতি।
বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় যার পদচারনা , সময়কে যিনি উপভোগ করেছেন নান্দনিক ভাবে তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি লেখক বা সাহিত্যিকদের লেখায় গল্প কবিতা ও গানে প্রেমিক অথবা প্রেমিকার দেখা মিলেছে যুগে যুগে।প্রেমে না পড়লে সাহিত্যে এত বিরহ আসত না। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ নারী প্রেমে সিক্ত হয়েছেন বারবার।তার দেখা মেলে তার সাহিত্য কর্ম ও বাস্তব জীবনে।
রোমান্টিক কবিদের যে যে বৈশিষ্ট্য থাকে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল। তীব্র কল্পনা প্রবনতা, সুক্ষ্ম সৌন্দর্য বোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধ ভাঙা আকর্ষণ রবি ঠাকুরের প্রেমানুভূতিকে দারুনভাবে প্রভাব আঘাত করেছে।নারীর শারীরিক উপস্থিতিকে তিনি প্রেমের অন্তরায় বলে মনে করতেন।ফলে প্রেমানুভুতির জন্য তিনি নারীর উপস্থিতিকে প্রাধান্য দিতেন না।প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে তিনি বরাবরই গৌন মনে করতেন।
বাংলা সাহিত্যে প্রেম যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিধৃত হয়েছে।প্রেম বিরহের সাহিত্য কর্ম সর্বদা মানবমনে অনন্য অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান অবিস্মরণীয়। উপন্যাস,গল্প গানে কবিতায় সে প্রকাশ খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র নাথ হচ্ছেন সেই প্রেমিক যিনি দেহজ বাসনা থেকে প্রেম কে মুক্তি দিয়েছেন। রবীন্দ্র নাথের প্রেম কে স্পর্শে ছোঁয়া যায় না। তার প্রেম বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে নান্দনিক ভাবে। মানসী কাব্যের নিষ্ফলা কবিতায় কবির প্রেমের উপস্থাপন দেখা যায় এইভাবে—
“সুতীক্ষ্ণ বাসনা ছুরি দিয়ে
তুমি যাহা চাও ছিঁড়ে নিতে?
লও তার মধুর সৌরভ
দেখ তার সৌন্দর্য বিকাশ
মধু তার করোনা তুমি পান
ভালবেসে প্রেমে হও বলী
চেয়োনা তাহাতে।
আখাংকার ধন নহে আত্মা মানবের
শান্ত স্পন্দন! স্তব্ধ কোলাহল।
নিভাও বাসনা বহ্নি নয়নের ধীরে
চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।”
কবি গুরু ভালো বেসে ভলী হতে বলেছেন।কামনার আগুনে গনকে নিভাতে বলেছেন। তিনি বলেছেন নারী আখাংকার ধন নয়, ভালবাসার ধন। অনেক দিন পর ফেলে আসা জীবনের মানুষ ও মুহূর্তগুলোকে রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি পটে বাঁচিয়ে রেখেছেন সযত্নে মায়াবী ছোঁয়ায়। যে কোন কবিতার অর্থ পাঠকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোনের উপর অনেকটা নির্ভর করে । তবুও কখনো কখনো কবিতার বাস্তবতা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে হয়।
ফেলে আসা মোহনীয় স্মরনীয় মুহূর্ত কে পংক্তি যে রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলেছেন দারুনভাবে তার — তুমি কি কেবলি ছবি” কবিতয়——-
” তুমি কি কেবলি ছবি ,শুধূ পটে লিখা
. ………..হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি।।
নয়ন সন্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়ে যে ঠাঁই- আছি তাই
শ্যমলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল
আমার নিখিল তোমারে পেয়েছে অন্তরের মিল।
নাহি জানি কেহ নাহি জানে——-
তবু সুর বাজে মোর গানে
কবির অন্তরে তুমি কবি
নও ছবি,নও ছবি,নও শুধু ছবি।।
শেষের কবিতা উপন্যাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালবাসার স্তর বিস্তারকে বারংবার দুমরে মুচড়ে দিয়ে ভেঙ্গে গড়ে সামাজিক বৈধ অবৈধতার সামান্যতা থেকে বহ পরে নিয়ে গিয়েছিলেন পাঠক কে। তাইতো কবি গুরু র লেখা কোনদিনই হারিয়ে যায় নি কালের স্রোতে,আর হারাবে নাও খুব সহজে।একজন মানুষের অনুভূতি যখন প্রেমের জন্য জাগ্রত হয় তখন সে অবচেতন মনে নিজের প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে বেড়ায়। লাবন্যের সঙ্গে অমিত রায়ের দেখা হওয়ার পর বলেছে—…………
” সেই শৈশব থেকে সমস্ত দিন যেন অবচেতন মনে তোমার পায়ের শব্দ শুনে আসছি। মনে হয়েছে কত অসম্ভব দূর থেকে যে আসছো- তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলে তো আমার জীবনে।”
শেষের কবিতায় অমিত রায় লাবন্য ও কেতকীর সম্পর্কে ব্যাখ্যা য় বলেছেন —-“
কেতকীর সাথে সম্পর্ক আমার ভালবাসারই। কিন্তূ সে যেন ঘড়ায় তোলা জল। প্রতিদিন তুলব। প্রতিদিন ব্যবহার করব।আর লাবন্যের সাথে আমার যে ভালবাসা তা হল দীঘি।সে ঘরে আনবার নয়। আমার মন তাতে সাথে দিবে।”
কবিগুরু মৌনতায় প্রেমের অবসান ঘটিয়েছেন বারবার।তবে রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীদের কে গেঁথে রেখেছেন কখনো তার কালজয়ী রবীন্দ্র সঙ্গীতে নানা ভাবে নানা ব্যঞ্জনায় মনের আকুলতায়।
” তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি
সকল খেলায় করব খেলা এই আমি
আহা কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে । বাঁধবে, বাঁধবে মোরে বাহুডোরে
………… যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে….।”
কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বসে কবি প্রেমের গান লিখেছেন………
“আকাশে পাতিয়া কান
শুনেছি শুনেছি তোমারি গান
আমি তোমারে সপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী”।
প্রেম ও প্রকৃতি তে কবি গেয়েছেন….
” অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে দিনের বিদায় ক্ষণে
গেঁয়ো না , গেঁয়ো না চঞ্চল এ গান ক্লান্ত সমীরনে।।
“অনেক কথা বলেছিলাম কবে তোমার কানে কানে
কত নিশিথ অন্ধকারে কত গোপন গানে গানে।।” ( প্রেম)
” কতবার ভেবেছিনু আপন ভুলিয়া
তোমার চরনে দিব হৃদয় খুলিয়া।
চরনে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশিত
গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি।”(প্রেম ও প্রকৃতি)
বিভিন্ন সময়ে কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে জীবনের নানা বাঁকে।দায় মোচন কবিতায় মনোভাব ব্যক্ত করেছেন……………
“…… দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করে মনে
যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে
হয়তও দেখিবে আমি শূন্য শয়নে
নয়ন সিক্ত আঁখি নীরে।”
“ব্যর্থ ” কবিতায় কবির প্রেমের উপস্থাপন দেখি এভাবে——-
” যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?
….. কেন দখিনা হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?”
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ প্রেমের ক্ষেত্রে শরীর কে গৌণ মনে করতেন ।’ সুরদাসের প্রার্থনা কবিতায় তা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। এই কবিতায় তিনি প্রেয়সীকে দেবী বলে সম্বোধন করেছেন।
“…….এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই
ফুটেছে মর্ম তলে
নির্বানহীন অঙ্গারসম নিশিদিন
শুধু জ্বলে
সেথা হতে তারি উপারিয়া লও
জ্বলময় দুটো চোখে
তোমার রাখিয়া তিয়াস যাহার
সে আঁখি তোমারি হোক।”
রবীন্দ্র নাথের প্রেমের কবিতায় নারী কে প্রায়শই ধরতে ছোতে পারিনা আমরা। চিত্রা কাব্যের বিজয়ীনি কবিতায় তাই প্রেমের দেবতাকেও দেখা যায় বিজয়ীর পদপ্রান্তে তীর ধনুক সমর্পণ করে তাকে দেবীর মতো প্রনাম করতে। রবীন্দ্র নাথের নারী যেন রক্ত মাংসের নারী নয় , দেবী।
রবীন্দ্র নাথ তার উপহার কবিতায় কাদম্বরী দেবী কে সখী বলে উল্লেখ করেছেন।
” মনে আছে সে কি সব কাজ সখী
ভুলায়েছ বারে বারে
বদ্ধ দোয়ার খুলেছ আমার
কংকন ঝংকারে।”
রবীন্দ্র নাথের কাব্য গ্রন্থের বিচিত্র ভাবধারায় এসেছে বিচিত্র নারী প্রেমে। কখনো একটা প্রাধান্য পেয়েছে কখনো অন্যটা। আবার কখনো নতুনের আগমনে সব পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়েছে। কবির ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে——
” তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায়
নব প্রেমজালে।”
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও পূরবীতে প্রেমের আবেশে কবি বলতে পেয়েছিলেন……………
” ফাগুনের চম্পক রাগে
সেই রঙ জাগে
ঘুম ভাঙ্গা কোকিলের কুজনে
সেই রঙ লাগে।”
প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছেও কবি গুরু বিদেশীনির উদ্দেশ্য লিখতে পেরেছিলেন………
“তোমার দেখার স্মৃতি নিয়ে
একলা আমি যাব ফিরে
…. ফিরে দেখা হবে না তো আর
ফেলে দিও ভোরে গাঁথা ম্লান মল্লিকা মালা খানি
সেই হবে স্পর্শ তব। সেই হবে বিদায়ের বানী।”
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭৭২২৪৮২২৪
sdsubrata2022@gmail.com