মোহাম্মদ রফিক:  ছিলেন মননশীল আধুনিক কবি 

।।এস ডি সুব্রত ।। “তুমি নেই, চলে গেলে,
অন্ধকার নয়, দেখি আলো,
চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত আলো
জীবনের আলো, মরণের আলো,
শেষ বিকেলের আলো
খেলা করে চোখে মুখে
এই আলোতেই ঘটে বিপদ ভঞ্জন,
মৃত্যু তবে শেষ নয়, শুরু,
আলোতেই হোক তবে অন্তিম উত্থান!
( অন্তিম উত্থান – মোহাম্মদ রফিক)।
যিনি নিজে লড়েছেন সব সময়, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যার কবিতা দিয়েছে সাহস, সেই মননশীল কবি মোহাম্মদ রফিক আর নেই আমাদের মাঝে। রোববার বরিশাল থেকে ঢাকা ফেরার পথে ০৬ আগস্ট ২০২৩ ইং রোববার রাত দশটায়  তার মৃত্যু হয় বলে পারিবারিক সূত্র জানায়। মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। কবির ভাই মোহাম্মদ তারেক দেশ রূপান্তরকে বলেন, কবি মোহাম্মদ রফিক বরিশালে বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। রোববার রাতে সেখান থেকে থেকে ঢাকা আসার পথে রাজৈর উপজেলায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গাড়িতে থাকা অবস্থায় তার বমি শুরু হয়। পরে সেখানকার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি আরো বলেন, কবিকে ঢাকা আনা হবে না। তার মরদেহ বাগেরহাটে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে দাফনের ব্যবস্থা করা হবে। কবি মোহাম্মদ রফিকের জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে বাগেরহাটে। ২০১০ সালের একুশে পদকপ্রাপ্ত এ কবি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। একজন মননশীল আধুনিক কবি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মোহাম্মদ রফিক খুলনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর রাজশাহী সরকারি কলেজে ইরেজি বিভাগে ভর্তি হন এবং স্নাতক শেষ করেন। পাকিস্তান আমলে ছাত্র আন্দোলন ও কবিতায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ যুগিয়ে তিনি বিখ্যাত হন সবার কাছে । ১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশ পায় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধুলার সংসারে এই মাটি’।
কবির উল্লেখযোগ্য অন্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- কীর্তিনাশা , খোলা কবিতা ও কপিলা ,গাওদিয়ায় ,স্বদেশী নিশ্বাস তুমিময় , মেঘে এবং কাদায় , রূপকথা কিংবদন্তি ,মৎস্য গন্ধ্যা , মাতি কিসকু , বিষখালি সন্ধ্যা , নির্বাচিত কবিতা  ,কালাপানি , নির্বাচিত কবিতা , নোনাঝাউ , দোমাটির মুখ , ত্রয়ী , মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী-১ , মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী-২ । কবিতার পাশাপাশি তার গদ্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ভালবাসার জীবনানন্দ , আত্মরক্ষার প্রতিবেদন , স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরাল ।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান মোহাম্মদ রফিক। এ ছাড়া আলাওল পুরস্কারসহ (১৯৮১) বিভিন্ন পুরস্কার  ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মোহাম্মদ রফিকের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এসময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। তখন সামরিক আদালতে তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশেও পরে তিনি সামরিক শাসকের রোষের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন রফিক, স্বাধীন বাংলা বেতারেও তিনি কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন রফিক। ২০০৯ সালে তিনি অবসরে যান।
মননশীল আধুনিক কবি মোহাম্মদ রফিক আলোচিত হয়ে আছেন গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের রিরাগভাজন হয়ে।সে সময়  এরশাদকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘খোলা কবিতা’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতা, যার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এমন- ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’। এই কবিতা তখন কেউ ছাপাতে সাহস পায়নি। গোপনে তা ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। এভাবে হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে তোলা এই কবিতার জন্য মোহাম্মদ রফিককে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তার নামে হুলিয়াও জারি হয়। তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল সে সময় ।
“মরণেতে পেতেছি বাসর
কোথায় সে সর্পদেবী
কে তবে দংশিবে আজ রাতে,
দুই ঠোঁট মেলে দিয়ে তুমি
শ্বাস নাও গহীন আশ্লেষে
আমি দেখি, ঢেউ ভাঙে দুই তীর জুড়ে”
( নদী ও নারী – মোহাম্মদ রফিক)
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম