মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে: ডিসি চাঁদপুর

চাঁদপুরে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে মহান বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন

চাঁদপুর:  চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অঞ্জনা খান মজলিশ বলেছেন, মহান বিজয় দিবস। জাতীয় জীবনে আমাদের গৌরবময় দিন। বিশ্বের বুকে লাল সবুজের পতাকা উড়ানোর দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ভাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে অন্যন্য ইতিহাসের রচনা করেন। তাই জাতীয় জীবনে গৌরব ও অহংকারের দিন আজ। আজ আমরা বিজয়ের ৫০ বছরে পদার্পণ করলাম। বিজয়ের এই মাহেন্দ্র ক্ষনে আমি সকলকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, সকল শহীদ এবং নির্যাতিত মা-বোন ও ৪ নেতাকে। যাদের রক্ত ও আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। একই সাথে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ সকল শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) সকালে চাঁদপুর স্টেডিয়ামে মহান বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে নির্ধারিত কর্মসূচি আনুষ্ঠানিক জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শান্তির প্রতিক পায়রা, বেলুন উড়ানো, কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালম গ্রহন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে ভাঙালি জাতির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষন ও বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। আর এই শোষণ, লাঞ্চনা ও নির্যাতন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি রচনা করে। শুধু অর্থনৈতিক শোষনই নয়, বাঙালি সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপরও তার নীপিড়ন শুরু করে। যার ফলে বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয় ‘৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যূত্থান এবং ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। এরই পরিক্রমায় ১৯৭১ সালে বাংলার নিপীড়ত জনগণ সশস্র যুদ্ধেলীপ্ত হয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার নতুন সূর্য। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীনতার মহান রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে রচিত হয় লাল সবুজের নতুন এক পতাকা। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ নামক নতুন ভুখন্ডের।

ডিসি বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনে সবচাইতে গৌরবদীপ্ত আখ্যান রচিত হয়েছিল ডিসেম্বরে। মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে দেশ মাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল অকুতভয় বীর বাঙালি জাতি। এই যুদ্ধে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যয়ের যুদ্ধ। শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের যুদ্ধ। পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ। বন্ঝনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের যুদ্ধ। সে যুদ্ধে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনে দেশকে স্বাধীন করেছি। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা উদ্বেলিত করে বিশে^র বুকে নতুন করে বাঁচতে শিখায়। তাই ডিসেম্বর এলে অধিকার আদায়ের নতুন উদ্যোমে আত্মবিশ^াসে বলিয়ান হই আমরা।

চাঁদপুরবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে চাঁদপুর জেলা অঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত। সারাদেশের ন্যয় চাঁদপুরের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্রযুদ্ধে লীপ্ত হয়েছিল। জীবন বাজি রেখেছিল এবং আত্মহুতি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বরে এই জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছিল। আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত চাঁদপুরের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের আত্মত্যাগ ও মরণপণ সংগ্রামের ফলে চাঁদপুর হানাদার মুক্ত হয়েছে। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি চাঁদপুরের বীর শহীদদের।

অঞ্জনা খান বলেন, বর্তমান সরকার জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্ণিমানে বদ্ধ পরিকর। সরকার তথ্য প্রযুক্তির সহযোগিতায় বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত অসম্রদায়িক মধ্যম আয়ের দেশে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ। ২১০০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশে^র মধ্যে স্বপ্নের ভুস্বর্গ। সে লক্ষ্যে সরকার ডেল্টাপ্লান করে কাজ করে যাচ্ছে। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ণ করার জন্য চাঁদপুরে বাস্তবায়িত হচ্ছে নানাবিধ উন্নয়ন কাজ।

চাঁদপুর জেলার উন্নয়ন সম্পর্কে ডিসি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষে চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিন উপজেলায় স্থাপতি হচ্ছে হাইটেক পার্ক। এছাড়া এই জেলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রসারে মতলব উত্তর উপজেলায় ও হাইমচর উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দু’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। যা চাঁদপুর জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বেকার সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এছাড়ও স্থাপন করা হচ্ছে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও অস্বচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরী করা হচ্ছে বীর নিবাস। পাশাপাশি এ জেলার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনবাসন করা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে ১৫৭টি পরিবারকে পুনর্বাসন করার জন্য গৃহ নির্মাণের কাজ চালু রয়েছে। ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য চাঁদপুরে আমাদের কার্যক্রম চালু রয়েছে। তারই পক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর ১০জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টুনির আওতায় গত ১ বছরে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩শ’ ৪জন উপকারভোগীকে ১শ’ ৩৬ কোটি ২২ লাখ ৩১ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। এই অর্থবছরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা বাবদ ৩৭ কোটি ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৩০৬ টাকা প্রদান করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, ইলিশের বাড়ী চাঁদপুরকে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়ীত শহরের মোলহেডে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু পার্ক। এছাড়াও পার্কটিকে আরো পর্যটক বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করা হয়েছে নানা উদ্যোগ। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চাঁদপুর জেলায় একজন মানুষও যাতে অনাহারে না থাকে সেজন্য এই জেলায় ৪ কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার ৫শ’ টাকা অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। এছাড়াও ১৪শ’ ৬১ মেট্টিক টন চাল, ১৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য, ২৫ লাখ টাকার গোখাদ্য, ৩হাজার ৭শ’ ৬৫ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, নাগরিক সেবা বৃদ্ধির জন্য জেলা প্রশাসনের আওতায় প্রদত্ত সেবাসমূহকে অনলাইনে করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে এ জেলার ভূমিসেবা কার্যক্রম অনলাইনে শুরু হয়েছে। নাগরিক ভোগান্তি হ্রাসে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আমি নিয়মিত গণ শুনানি করে যাচ্ছি। এছাড়াও জেলাধীন অন্যান্য দপ্তর সমূহ নাগরিক সেবা বৃদ্ধিতে তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার যে লক্ষ নির্ধারণ করেছে তা অর্জনে চাঁদপুরবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এই হোক মহান বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। এই হউক আমাদের কাজে কথায় ও মর্মে। মঙ্গল হউক আমাদের সকলের। বাংলাদেশ চীরজীবী হউক।

চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানজিদা শাহনাজ, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবিদা সিফাত, বীর মুক্তিযোদ্ধা অজয় কুমার ভৌমিক, সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া জীবন ও এম আর ইসলাম বাবুর যৌথ সঞ্চলনায় আরো বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর জেলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিলন মাহমুদ পিপিএম (বার)।

শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত করেন পুলিশ লাইন জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুস সালাম এবং গীতা পাঠ করেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের বিমল চক্রবর্তী।

সবশেষে কুচকাওয়াজ, ডিসপ্লে ও শারিরীক কসরতে অংশগ্রহনকারী বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।

ফম/এমএমএ/

শাহরিয়া পলাশ | ফোকাস মোহনা.কম