মাটিদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ও এর প্রতিকার

প্রতিকী ছবি।

ধরিত্রী সরকার সবুজ।। মানুষসহ সব প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য ভূমি বা মাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। মাটিতে জন্মানো উদ্ভিদ থেকেই আমরা খাদ্য পাই। মাটির ওপরের স্তরের উৎকর্ষের ওপর মাটির উর্বরতা ও উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে। মাটির ওপরই সব প্রাণীর চলাচল।

মাটির ওপর ঘরবাড়ি তৈরি করে আমাদের বসবাস। আবার আমাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডের কারণেই মাটির বিভিন্ন উপাদান নষ্ট হচ্ছে। কখনো মাটির মধ্যে দূষিত পদার্থ মিশে যাচ্ছে, মাটির ক্ষয় হচ্ছে, মরুময়তার বিস্তার হচ্ছে, লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে বা মাটির গুণাগুণ হ্রাস পাওয়ার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। মাটির ওপরের পুষ্টি উপাদান হ্রাস পাচ্ছে, মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধিকারী জীবাণুর জীবনধারণে ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। এ ধরনের ভূমিদূষণ বা মাটিদূষণের ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু প্রাণী ও উদ্ভিদসহ সব ধরনের জীববৈচিত্র্যের জন্যই মাটিদূষণ খুব ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিতে একসময় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগল। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ল। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে এবং ফসলের অধিক ফলন পাওয়ার জন্য রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে কীটনাশকের ওপর কৃষকের নির্ভরশীলতা বেড়েছে অনেক। জৈব সার ও জৈব বালাইনাশকের পরিবর্তে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে এসব রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। ক্ষেতের ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গে মাটির জন্য উপকারী কীটপতঙ্গকেও ধ্বংস করে ফেলছে এসব কীটনাশক। আবার শুধু যে জমিতে এগুলো দেওয়া হচ্ছে সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের একটি অংশ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের মাটিতে এবং দূষণ পদার্থের উপাদানেরও বিস্তার ঘটছে সঙ্গে সঙ্গেই।

আবার কখনো কখনো ইটখোলাগুলো ইট তৈরির জন্য মাটি কিনে নেয়। কৃষিজমির মালিক একটি ফসল উঠে যাওয়ার পর অনেক সময় নগদ অর্থের প্রয়োজনে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করে দেন। কিন্তু এতে ভূমির উর্বরাশক্তি কমে যায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে ফসল উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে। নভেম্বর মাসের দিকে যখন ইটের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইটখোলাগুলো পরিপূর্ণভাবে ব্যস্ত থাকে, তখন জমির মাটির চাহিদাও বেশ বৃদ্ধি পায়। মূলত ফসলি জমির উপরিস্তরের ৭ থেকে ১০ ইঞ্চির মধ্যে জৈব উপাদান এবং খাদ্য গুণাগুণ থাকে। জমির উর্বরাশক্তির জন্য এ স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জমির মালিক এ স্তরের মাটি বিক্রি করে দিলে ফসলের উৎপাদন অনেক কমে যায়। আবার একবার ফসলি জমির মাটি কাটা হলে তার উৎপাদনক্ষমতা বা উর্বরাশক্তি ফিরে আসতে ৮-৯ বছর সময় লেগে যায়। অর্থাৎ উপরিভাগের মাটি বিক্রি দীর্ঘ মেয়াদে ফসল উৎপাদনে একটি ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে।

দেশে শিল্পায়ন বাড়ছে। নানা ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হয় নানা ধরনের কাঁচামাল এবং সেখান থেকে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য পদার্থও উৎপাদিত হচ্ছে। অর্থাৎ শিল্পায়ন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-কারখানার বর্জ্য পদার্থের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্প-কারখানার বর্জ্যগুলোর সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা খুব জরুরি। কিন্তু অনেক সময়ই সেটি করা হচ্ছে না। বরং অনেক সময় শিল্প-কারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য পার্শ্ববর্তী উন্মুক্ত মাঠ, বনজঙ্গল বা নদীতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিল্প-কারখানার রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণের ফলে ওই সব স্থানের মাটি ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। মাটির এ ধরনের দূষণ মানবস্বাস্থ্য ও উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর নানা ধরনের রোগব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে। দূষিত এ মাটিতে ফসলের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি এসব এলাকার মাটির দূষিত ও ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ উদ্ভিদ অর্থাৎ ফসলের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মানবদেহে পৌঁছাতে পারে।

দেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অতি স্বল্পমূল্যের হওয়ায় প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে মানুষ খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু প্লাস্টিক বা পলিথিন বায়োডিগ্রেডেবল নয় এবং সহজে পচে যায় না বা মাটিতে মিশে যায় না। মাটির যে স্থানে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ পড়ে থাকে, সেখানকার মাটিকে এটি দূষিত করতে থাকে বছরের পর বছর। পলিথিন বা প্লাস্টিকের মাধ্যমে মাটিদূষণের বিষয়টি এখন গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এটি যে শুধু উপরিভাগের মাটি নষ্ট করছে তা নয়। এর একটা বড় অংশ নদীতে এবং সব শেষে সাগরে গিয়ে পড়ছে। ফলে নদীর তলদেশের মাটিও প্লাস্টিকদূষণের কবলে পড়ছে এবং মাছসহ সব জলজ জীবের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

ফসল যেহেতু মাটিতে জন্মায়, তাই সে মাটি হেভি মেটালে দূষিত হলে তা স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যশস্যে ঢুকবে। ফসলজাত খাদ্য উপাদানে থাকলে সেগুলো অনেক সময় তাপেও পুরোপুরি নষ্ট হয় না এবং মানুষের শরীরে ঢুকে মানবস্বাস্থ্যের নানা ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের আবর্জনার মাধ্যমে সিসা, দস্তা, ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি বিষাক্ত ধাতব পদার্থ ভূমিতে বা মাটিতে মিশে যাচ্ছে। গাড়ির ব্যাটারি, টায়ারের মতো দ্রব্যাদি ব্যবহার শেষে যখন বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয়, তখন এসব বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এগুলোর একটি অংশ মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এসব বিষাক্ত ধাতব পদার্থ মাটির গুণাগুণ মারাত্মকভাবে নষ্ট করছে। সার্বিকভাবে অতিরিক্ত পশুচারণ, খনিজ পদার্থ উত্তোলন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের অভাব, ভূমির জৈব পদার্থের হ্রাস মাটিদূষণের কারণ ঘটাচ্ছে।

আমরা একটু সচেতন হলে মাটিদূষণ অনেকটা কমিয়ে আনা যায় বা প্রতিরোধ করা যায়। শহর-নগরের গৃহস্থালি এবং শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত কঠিন ও তরল বর্জ্য পদার্থ পরিশোধন বা বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এবং যেসব আবর্জনা বা বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব, সেগুলো যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে জৈব সার উৎপাদনের মাধ্যমে মাটিদূষণ হ্রাস করা যায়। কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারলে এবং রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারলে তা মাটিকে সুস্থ রাখার জন্য সহায়ক হবে। বেশি করে গাছের চারা রোপণ ও বনায়ন কার্যক্রম মাটিদূষণ রোধ করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও মানুষের জীবনযাত্রায় বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা বাড়ছে এবং একই সঙ্গে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের দূষণ বাড়ছে। মাটি, পানি ও বায়ু পরিবেশের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং প্রাণিকুলের জীবনধারণের জন্য এ উপাদানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের ফলে তিনটি উপাদানেরই দূষণ ঘটছে।

তবে বায়ুদূষণ ও পানিদূষণ নিয়ে আমরা যতটা সরব, ভূমিদূষণ বা মাটিদূষণ নিয়ে ততটা উচ্চকণ্ঠ নই। কিন্তু এ ধরিত্রীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রাখতে হলে প্রথমেই ভালো রাখতে হবে মাটিকে। এ পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি মাটি দূষণমুক্ত রাখব-এ প্রত্যয় নিয়ে হোক আমাদের পথচলা।

লেখক : পরিবেশবিষয়ক লেখক।

ফোকাস মোহনা.কম