মাগো ওরা বলে : আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (নিবন্ধ)

।। এস ডি সুব্রত।। 
” চিঠিটা তার পকেটে ছিল
 ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা ।
মাগো, ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে ।
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না ।
বলো, মা, তাই কি হয়? “– আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ।
বাংলাদেশের একজন মৌলিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। পঞ্চশের দশকে একুশের চেতনা ও স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলা সাহিত্যে একঝাঁক তারুণ কবির অভিষেক ঘটে যাদের মধ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অন্যতম। সরকারের সচিব, মন্ত্রীর পরিচয় ছাপিয়ে একজন কবি হিসেবেই তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জীবনে যা কিছু করেছেন, শেষ পর্যন্ত কাব্যচর্চাই তার অনিবার্য গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বরিশাল জেলার এর বাবুগঞ্জের বাহেরচরের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল জব্বার খান পাকিস্তানের আইন পরিষদের স্পিকার ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এম.এ. পাস করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। ১৯৮২ সালে তিনি সচিব হিসেবে অবসর নেন এবং রাষ্ট্রপতি এরশাদের সরকারে মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।পরবর্তী কালে ১৯৯২ সালে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায়।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালপুরুষ। তার কবিতায় আমাদের বীরত্বগাথা যেমন উঠে এসেছে তেমনি এসেছে এ দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কথা। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ভাবা যায় না। সাতচল্লিশোত্তর বাংলা কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একটি বিশিষ্ট নাম। দশক বিচারে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মূলত পঞ্চাশ দশকের কবি। পঞ্চাশের দশকেই তাঁর কবি হিসেবে আবির্ভাব এবং এই দশকেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাতনরী হার’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে।পঞাশ দশকের সঙ্গে চিহ্নিত ও ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর লেখায় সমকালীন বাস্তবতা এবং প্রকৃতির কথাই বারবার উঠে এসেছে অবলীলায় । তিনি লোকজ ঐতিহ্যের ব্যাবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। কাব্যের আঙ্গিক গঠনে এবং শব্দ যোজনার বিশিষ্ট কৌশল তাঁর স্বাতন্ত্র চিহ্নিত করে। যদিও তিনি লোকজ ধারায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন তথাপি তাঁর কবিতায় আধুনিকতা এবং আধুনিক কবিতার আঙ্গিকের কমতি ছিল না কোন ক্রমেই।
এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল তাত্‍পর্যপূর্ণ অবদান। সবধরনের কর্মকাণ্ড, মিছিল-মিটিং সবখানেই তাঁর ছিলো সরব উপস্থিতি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিলো উল্লেখযোগ্য অবদান। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন শাসক গোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি বর্ষণ করে এবং শহীদ হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ‘৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, মিছিলে, মিটিঙে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। ‘৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল। সেই বেদনা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত আবেগময় কবিতা ‘কোন এক মাকে’ , যা তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। এছাড়াও রয়েছে ‘মাগো ওরা বলে’ উল্লেখযোগ্য কবিতা। কবিতাটি  ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ১৯৫২ সালের মহান একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমিকায় রচিত হয়েছিল ‌ । কাব্যের আঙ্গিক গঠনে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি । প্রকৃতির রূপ ও রঙের বিচিত্রিত ছবিগুলো তার কবিতাকে মাধুর্যমণ্ডিত করেছে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : কবিতা, সাত নরীর হার (১৯৫৫), কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তির কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), প্রেমের কবিতা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ প্রভৃতি। কবি  বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হল- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯) ও একুশে পদক (১৯৮৫)। কবি ২০০১ সালের ১৯ মার্ঢ এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।’
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর এই কবিতা আমাদের অন্তরের প্রকোষ্ঠে কড়া নাড়া দিয়ে  জানিয়ে দেয় মানুষের শেকড়ের কথা। এই কবিতার লেখক কবি ‘আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’। কাব্যের আঙ্গিক গঠনে এবং শব্দ যোজনার বিশিষ্ট কৌশল তার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করেছে লেখালেখি শুরু থেকেই।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭৭২২৪৮২২৪ ।
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম