ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা

শেখর ভট্টাচার্য।। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় নিয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। ’

১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর এই ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সত্যিকার রূপটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন। সদ্যঃস্বাধীন পাকিস্তানে ভাষার প্রশ্নে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি, ‘…নোতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে জনগণ প্রমাণ করবে যে তারাই রাজা, উপাধিধারীদের জন-শোষণ আর বেশিদিন চলবে না। বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।

বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা, তা যে শুধু ব্রিটিশশাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানশাসিত অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে সম্প্রসারিত হয়েছিল, তা নয়। এর বহু আগে থেকে, বিশেষ করে তুর্কিশাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ’ এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গার্থক কথোপকথন বা কোনো রচনার পঙক্তি ছিল তা নয়, এই কবিতাটি ছিল অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের সহজ প্রকাশ। মধ্যযুগ থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে যখন বাঙালি স্বপ্নের স্বভূমি পাকিস্তানে প্রবেশ করে, তখন রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র দ্রুত বাঙালির সামনে উন্মোচিত হয় ভাষার প্রশ্নে। পাকিস্তান নামক অলীক স্বপ্ন ভঙ্গ এবং জাতিসত্তার ঐতিহ্য অন্বেষণের পরে বাঙালি সাংস্কৃতিকভাবে স্বভূমে ফিরে আসে। বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ স্ফটিক স্বচ্ছভাবে নিজেদের সামনে উপস্থিত হওয়ার ফলে জাতি হিসেবে বাঙালি আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। জাতিসত্তার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ফিরে আসাকেই গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বাস্তবতা যে চেতনার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি ছিল বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা সাতজনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাঙালি সংস্কৃতির উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বজনীনতার মতো এর কুঠরিতে আছে আত্মপরিচয়কে নিরাপদ রাখার এক অপূর্ব শক্তি। সে শক্তি থেকেই জোরালো হয়ে ওঠা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষার দাবি। দাবি মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে জোর করে পাকিস্তানীকরণের চেষ্টা চালানো হয় নানাভাবে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের অপপ্রয়াসে লিপ্ত হন পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের সহযোগী বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। নজরুলের রচনাকে আংশিক ও খণ্ডিতভাবে গ্রহণের হীন পদক্ষেপও তাঁরা নিয়েছিলেন। এসব হীন তৎপরতার বিরুদ্ধে তখন আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছে ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষার ওই আন্দোলনের অর্জন ছিল বাঙালির অনির্বাণ প্রেরণা।

প্রশ্ন হলো, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সংস্কৃতিগতভাবে বাঙালি যে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিল, এই প্রত্যাবর্তনকে কতটুকু মহিমান্বিত করা গেছে এ পর্যন্ত। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে জেগে উঠেছিল জাতিগত চেতনা। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। ভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত চেতনার বলেই আমরা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলাম ধর্মনিরপেক্ষতা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান থেকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসন দেওয়া হয় এবং নতুন করে সাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতা আবার সংবিধানে স্থান পায়। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও পঁচাত্তর-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাবে জাতির মধ্যে কিছুটা হলেও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। একইভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধান থেকে ছেঁটে ফেলে জাতিকে বিভক্ত করার জন্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জাতীয়তাবাদ যাঁরা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাঁদের অবচেতন মনে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে নিয়ে আসার একটি সুস্পষ্ট ইচ্ছা ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানে আবারও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা। দীর্ঘদিন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতাসীন থাকায় জাতির মধ্যে যে বিভক্তি দেখা যায়, সে বিভক্তির ফলেই জাতীয় ঐক্য অনেকাংশেই আজ ক্ষুণ্ন।

শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে যে খুব সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। মাতৃভাষা পরিত্যাগের নানামুখী তৎপরতা সমাজজীবনে মোটাদাগে দেখা যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাক্রমে তিনটি পৃথক ভাষা বিদ্যমান। সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঔপনিবেশিক ইংরেজি ভাষানির্ভর শিক্ষাক্রমে। অন্যদিকে প্রান্তিক-হতদরিদ্র শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা মাদরাসাগুলোতে। যেখানে আরবি ভাষাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ হচ্ছে, বাংলা ভাষা সেখানে হয় আরোপিত, না হয় অবহেলায় গৃহীত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু সাধারণের জন্য বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খল অবস্থা, তা কিন্তু আমাদের ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ভাষা আন্দোলনের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের কার্যক্রমের ওপর জাতীয় চেতনা বিকাশের প্রশ্ন জড়িত। একইভাবে বাংলা ভাষাকে শিক্ষা কার্যক্রম এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা ও দৃঢ়তা দুটিরই প্রয়োজন আছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বে এই দিনটি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। একুশের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে নিজ দেশে সফলভাবে বাস্তবায়নের নৈতিক দায়কে আরো জোরালো করে তুলেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মাতৃভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার করা ছিল ভাষাশহীদদের প্রতি জাতির অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে আমরা জাতীয়ভাবে যেমন এগিয়ে যেতে পারি, একইভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূতিকাগার হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তিকে সারা বিশ্বের সামনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারি। এসব কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব যদি আমরা আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় নিজেদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক।

ফোকাস মোহনা.কম