ভারতের ডাউকি মেঘালয় উমগট নদী ভ্রমন কাহিনী

উমগট নদীর পানি এতই স্বচ্ছ যে দূর থেকে মনে হয় নৌকাগুলো হাওয়ায় ভাসছে

লেখক মোঃ মহসিন হোসাইন।

।। মোঃ মহসিন হোসাইন ।। হঠাৎ দেখলে মনে হবে পানিতে নয়, যেন শূন্যে ভেসে ভেসে চলছে নৌকা! একটু ভালো করে তাকালে বুঝতে পারবেন নৌকার নিচের অসম্ভব স্বচ্ছ পানির সূক্ষ্ম আস্তরণ। অদ্ভুত নীল পানির এই নদীর নাম উমগট। পাহাড়ি নদীটির অবস্থান ভারতের মেঘালয়ে।

একটা নদীর পানি ঠিক কতটা স্বচ্ছ হতে পারে? এর উত্তর পেতে চাইলে আপনাকে উমগট নদীতে যেতেই হবে। কল্পনাকেও হার মানানো স্বচ্ছ পানি এখানে। ১০ ফুট থেকে শুরু করে ২০০ ফুট পর্যন্ত পানি একেবারে স্বচ্ছ। এতই স্বচ্ছ যে পানির নিচের পাথর, মাছ, সাপ, বালি- সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখা যায়। সূর্যের ঝলমলে আলো নদীর নিচ পর্যন্ত চলে যায় এক নিমিষেই।

ভর দুপুরে এই নদী পরিণত হয় ঝলমলে এক প্রাকৃতিক অ্যাকুয়ারিয়ামে। এখানে মাছের দল দৌড়ে চলে চোখের সামনে, নদীর নিচের টুকরো পাথরে সূর্যের কিরণ ঠিকরে পড়ে এক অদ্ভুত ভালোলাগায়। কাঁচের মতো স্বচ্ছ এই নদীতে ডুব দিয়ে আপনি দেখতে পারবেন পানির নিচের জগত। দেখতে পারবেন কীভাবে সংসার পেতেছে ছোটবড় মাছ। আর নৌকায় উঠে পড়লে দেখা মিলবে জীবন্ত অ্যাকুয়ারিয়ামের! রূপকথার মতো এই নদীটির পাড়ে তাঁবু টাঙিয়ে থাকতেও পারেন চাইলে।

উমগট নদীই আমাদের দেশে ঢুকেছে গোয়াইন নদী হিসেবে, যেটাকে আমরা অনেকেই বলি জাফলং নদী। বাংলাদেশের একদমই কাছে এর অবস্থান। জাফলং থেকে বড় জোর ৮ কিলোমিটার গেলেই পেয়ে যাবেন স্বচ্ছ পানির এই নদীটি। উমগটের সৌন্দর্য দেখতে চাইলে এখনই আদর্শ সময়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নদীর পানি থাকে স্বচ্ছ।

লেখক মোঃ মহসিন হোসাইন।

বেশ কিছুদিন আগেই বেড়াতে গিয়েছিলাম মেঘের বাড়িতে। তীব্র শীতের মধ্যেও মেঘের কি অফুরান আনাগোনা। সূর্যের সঙ্গে কানামাছি খেলে খেলে সবগুলো মেঘ ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই সময়টা। মেঘের ওপরে দৌড়েছি, পানির নিচে হেঁটেছি, পাহাড়ের ওপরে উটেছি! বাদ রাখিনি একটি সকালও। শিলং, মেঘালয়, চেরাপুঞ্জি—সব ঘুরে আমরা দেখেছি প্রকৃতির বিস্ময় লিভিং রুট ব্রিজ। দাঁড়িয়েছি পাহাড়ের একেবারে শেষ মাথায় স্মিতভ্যালিতে, যেখান থেকে একটু পা সড়ালেই কয়েক মাইল নিচে পড়ে যেতে হবে! ঘুরেছি এশিয়ার মহাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামে। সবশেষে অবাকের চূড়ান্ত হয়েছি স্বচ্ছ পানির উমগট নদী দেখে।

আমাদের সিলেটের তামাবিল সীমান্ত থেকেই ছানাবড়া চোখের শুরু। বাংলাদেশের পুরো উত্তর দিকটা দেয়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘালয়ের সব শেষ শহর ডাউকি। এখানেই বাজারে ডলার আর টাকা ভাঙিয়ে দেশের সীমানা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলাম পাংতুমাই ঝরনায়। যে ঝরনাটা বাংলাদেশ থেকে শুধু দেখা যায়। সেটার জলে গা না ভিজানোর মতো বোকামি আমরা কেউই করলাম না। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমাদের গাড়ি পৌঁছাল এশিয়ার রুয়াই গ্রামে। এখানে রয়েছে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টিলিভিং রুট ব্রিজ। পাহাড়ি ঝিরির দুই পাশের গাছ মিলে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে জীবন্ত এই সেতু। মাথার ওপরে জীবন্ত গাছ, পায়ের নিচে টলটলে পানি!

মেঘালয়ের এই রাস্তাগুলো এমনই, সারাক্ষণ মেঘ পড়ে থাকে এখানে। ফুঁ দিয়ে মেঘ সরিয়ে এগোতে হয় সামনের দিকে। কখনো অপেক্ষা করতে হয় সামনের মেঘ কেটে যাওয়ার জন্য, আবার কখনো অপেক্ষা করতে করতে দেখা মিলে অসম্ভব সুন্দর রংধনুর! প্রায় আড়াই ঘণ্টার মেঘের রাস্তা পেরিয়ে চলে গেলাম শিলং শহরে। পাহাড়ের ওপর থেকে ঘুরে ঘুরে এখানে নামতে হয়। ওপরে তাপমাত্রা ১০-১১ ডিগ্রি, সেটা এই শহরে ১৬-১৮ ডিগ্রি। ছবির মতো সাজানো-গোছানো পরিকল্পিত এক শহর। আমি ছিলাম লাবাং এলাকায়। প্রতিটা বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো। এখানে প্রায় সবাই বাংলাদেশি। দেশভাগের সময় যাঁরা এ দেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা সারা জীবনের জন্যই আস্তানা গড়েছেন সেখানে। শিলং ছোট্ট শহর। এখানেই সবকিছুই পুলিশ বাজারকে ঘিরে। এলিফ্যান্ট ফলস, সুইট ফলস, উমিয়াম লেক, এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাথেড্রাল, শিলং পিক, লেডি হায়দার পার্কসহ আরও অনেক জায়গা আছে দেখার জন্য। তবে সবাইকে একধাক্কায় কাত করে দিয়েছে স্মিতভ্যালি। হুট করে দেখলে দেখা যাবে পুরো পাহাড়ে সাগরের ঢেউ লেগেছে। ঢেউ টিনের মতো ঢেউ ঢেউ এই স্মিতভ্যালি। যত দূর চোখ যায় কোনো গাছপালা নেই, সোনালি ঘাস বিছানো পুরো ভ্যালিজুড়ে। এখানের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, পাহাড়টা হুট করে শেষ হয়ে গেছে, একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়ালে মনে হবে দুনিয়ার শেষ মাথায় বুঝি চলে এসেছি।

পরদিন আমরা গেলাম মওকডক ভ্যালি। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে রশি দিয়ে ঝুলে ঝুলে যেতে হবে। সেখানে ৮০০ রুপি করে লাগল। সেদিন ওই দড়িতে না ঝুলে পড়লে জানতামই না বিশাল পাহাড়ের মাঝে একাকী হয়ে গেলে জীবনের অর্থই পাল্টে যায়। দুই পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে যখন ঝুলে ঝুলে ছুটে যাচ্ছি, তখন আমার পাযের নিচে বিশাল এক ঝরনা। নিজের কালো ছায়াটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে অচিন দেশের সবুজ পাহাড়ে!

পৃথবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় চেরাপুঞ্জিতে। এখানেই দেখা মিলে বিশ্ববিখ্যাত সেভেন সিস্টার ওয়াটার ফলসের। মেঘালয়ের সাতটা রাজ্যের পানি এখানে এসে পড়ে বলেই এর নাম সেভেন সিস্টার্স। এসব পানি সিলেটের ভোলাগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। সেভেন সিস্টার্সের একেবারে মাথায় এসে দাঁড়ালে পরিষ্কার দেখা যায় বাংলাদেশের গোটা সুনামগঞ্জ এলাকা। এখান থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম নোহকালিকাই ওয়াটার ফলসে। বাঙালিরা দুষ্টুমি করে একে বলে নোয়াখালী ফলস!

ফেরার পথে পরিকল্পনা ছিল উমগট নদীর পাড়ে রাত কাটিয়ে পর দিন ঢুকে যাব বাংলাদেশে। মাঝরাতে পৌঁছালাম উমগটে, সেখানে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা তাঁবুতে ব্যাগ রেখে অমাবস্যার আলোতে চালিয়ে দিলাম ক্যাম্প ফায়ার আর বার-বি-কিউ। সকালে চোখ মেললাম স্বচ্ছ জলের এক নদীতে। নদীর পানি এতই স্বচ্ছ যে দূর থেকে নৌকাগুলোকে দেখলে মনে হবে হাওয়ায় ভাসছে! এর অবস্থান ভারতের মেঘালয়। জাফলং থেকে বড়জোর ৮ কি.মি.। গাড়িতে যেতে লাগে ২০ মিনিট। কোনো ক্যামেরার লেন্সে এই সৌন্দর্য তুলে ধরা যাবে না। এখানে ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেড়ালেই মাছেদের সংসার দেখা যায়, গোনা যায় পাথরের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য টিকেও!

লেখক মোঃ মহসিন হোসাইন।

যেভাবে যাবেন:

তামাবিল-ডাউকি বন্দর দিয়ে ভারতের ভিসা করিয়ে নিন। সোনালী ব্যাংকে ৫০০ টাকার ট্র্যাভেল ট্যাক্স জমা দিয়ে কোনো এক শুভদিন দেখে রওনা করে দিন। ডাউকি থেকে শিলং আড়াই ঘণ্টার স্বর্গীয় পথ। বাংলাদেশি টাকায় ৮ থেকে ১০ হাজার দিয়ে অনায়াসেই তিন দিন ঘুরে আসতে পারবেন। মেঘালয়ে যেকোনো সময়েই যেতে পারবেন। সারা বছর সেখানে মেঘ থাকে।
বাসে করে সিলেটে চলে যান। এরপর তামাবিল বর্ডার পার হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে যান ডাউকির উমগট নদী। ট্যাক্সি ভাড়া পড়বে ৩৫০ রুপি। সময় লাগবে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। ট্যাক্সি সোজা সোনেংপেডাং গ্রামে নিয়ে যাবে, সেখানে নেমে পায়ে হেঁটে উমগট নদীর উপরে ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে নদীর পাড়ে যাওয়া যায়। নদীর পাড়ে তাঁবু টাঙিয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। ৪ জনের তাঁবুর খরচ পড়বে ১৫০০ রুপি, ২ জনের তাঁবুর ভাড়া ১০০০ রুপি। উমগট নদীতে রয়েছে বোটিং করার ব্যবস্থা। ঘণ্টায় ৫০০ রুপি মতো পড়বে খরচ।
ঢাকা থেকে যেকোনো দিন রাতের ট্রেনে সিলেট চলে যেতে পারেন খুব সকালে। স্টেশনের পাশের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে দেড় ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন তামাবিল সীমান্তে। পাসপোর্টে কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ভারতে প্রবেশ করে সেখানেও একই রকম আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, আধা কিলোমিটার হেঁটে ডাউকি বাজার থেকে ৩০/৫০ রুপি দিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন এক টলটলে স্বচ্ছ জলের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম সোনাংপেডাং।

পাথরে, বাঁশের সেতুতে, পাহাড়ের যে কোনো প্রান্তে বসে আপনি প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারবেন স্বর্গীয় দৃশ্য। যার চারপাশে আপনাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্যে অরণ্যে ঢাকা সুবিশাল পাহাড়ের দেয়াল। এই সবুজ পাহাড়ের দেওয়ালে বসে আছে রঙিন পাহাড়ি ঘরবাড়ি। নদীর জলে, পাথরে পাথরে ভেসে আছে নানা রঙের নৌকা কায়াকিং এর জন্য প্রস্তুত হয়ে। আছে স্রোতে ভেসে চলার জন্য রোমা কর রাফটিং এর আয়োজন। আর আছে দুই পাহাড়ের মাঝে দোলনায় দোল খাওয়ার মতো অদ্ভুত রোমা কর সেতু। যেখানে উঠে গা ছমছম করবে যে কারুর, কিন্তু একটা ভিন্ন রকম রোমা আপনাকে অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে রাখবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

লেখক পরিচিতিঃ মোঃ মহসিন হোসাইন
লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত)- বাংলাদেশ তৃণমূল সাংবাদিক কল্যাণ সোসাইটি।

ফোকাস মোহনা.কম