১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ সাল ।এদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় । এদিনটির জন্য এ মাসটিতে বেদনাচ্ছন্ন থাকি । কেনো, জানি না।
আমি তখন ঢা বি র ইংরেজি বিভাগের সম্মান শ্রেণির ২য় বর্ষের ছাত্র । থাকতাম নব নিরমিত হল- স্যার এ এফ রহমান হলে। তখন ভিসি ছিলো দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ড. আ: মতিন চৌধুরি। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবি। ছাত্রজীবনে সব পরীক্ষায় ১ম হয়েছেন । তিনি ছিলেন বোস প্রফেসর। তাঁর বিশেষায়িত বিষয় ছিলো পদার্থবিজ্ঞান । তিনি অক্সফোর্ড/হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি করেন। তাঁকে এ সেরা বিশ্ববিদ্যালযৈর জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ঢা বি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর আ রাজ্জাক।তাঁর সুপারিশকে ওই বিশ্ববিদ্যালয় খুব সম্মান করতো। ড. মতিন ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালো বাসতেন, স্নেহ করতেন। আমরাও সেই স্নেহ পেয়েছি ।
হঠাৎ একদিন গভীররাতে নতুন ছাত্রাবাস- এ এফ রহমান হলে নাইটগাউন পড়ে দেখতে আসলেন ‘ আমরা কী করি, কিভাবে থাকছি , সচক্ষে দেখতে আসলেন ।তখন আমরা ফ্লোরে ঘুমাতাম, খাট পাইনি তখনো। তিনি একদিন ছদ্মবেশে আসলেন রাত ১২টার পর । জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললেন “এই ছেলে, তুমি মেঝেতে ঘুমাও কেনো ? ঠান্ডা লাগবেতো, তোমারতো জ্বর হবে ? আমি বললাম, “তো আপনার কী ? আপনি কে ?’’ বললেন আমি মতিন চৌধুরি । লাফ দিয়ে উঠলাম, “ স্যার আপনি এতো রাতে !’’ ’’তোমাদের অবস্থা দেখতে এসেছি ’’। বললো আমি কালই বংগবন্ধুকে বলবো “এ হলের বাকী কাজ যেনো দ্রুত শেষ করা হয় ‘’ “আমার ছাত্ররা কষ্ট পাচ্ছে ।’’
১৫ আগষ্ট সকালে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বংগবন্ধুর সরকারি সফর ছিলো ঢা বি তে। এদিন এ সফরকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে আকষর্নীয়ভাবে সাজসজ্জা করা হয়েছিলো। গাছগাছালির অধের্কটাও রং করে সাদা করা হয়েছিলো।
সবার ধারনা ছিলো ‘’ এদিন ঢা বি তে স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য কিছু করা হবে।অনেককে ডি লিট ও ডক্টরেট ডিগ্রিও প্রদান করা হবে। ঢা বি কে আরো উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপ দেয়া হবে – যা হবে উপমহাদেশে অনন্য।’’
সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকগন ছিলেন উদ্বেলিত । টান টান উত্তেজনা ছিলো সবার মধ্যে।
আমি স্যার এ এফ রহমান হলে A ব্লকের তিন নম্বর রুমে তখন বাস করছিলাম। সাথে চাঁদপুরের কল্যাণদী গ্রামের আ: মান্নান, মুনিরউদ্দীন খান, ও অন্য একজনও ছিলেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট খুব সকালে ফজর নামাজ পড়ে অজিফা শরিফ পড়ার সময় হঠাৎ অন্য রুমের এক বন্ধু এসে জানালা দিয়ে বললো “ দেলোয়ার ভাই, শেখ মুজিবকে তো মেরে ফেলা হয়েছে ! তিনিতো ঢা বি তে আসবেন না।’’ আমি বললাম “ এসব কথা বলবেন না। ভাই চলে যানতো ’’ । আসলে ওরা সবাই ছিলো শিবিরের কর্মী ।ওরা মনে হয়েছে এটাতে খুশী ! পরে আবারো এসে বললেন “একটু আসুন । প্লিজ আসুন না । রেডিও শুনুন ‘’। রেডিওতে শুনে হতবাক হলাম বৈ কি । বার বার বলা হচ্ছিলো “ আমি মেজর ডালিম বলছি .মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে…… । কেউ ঘর থেকে বের হবেন না্ । সারা দেশে কারফিউ ‘’।
একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না ।কি হলো ! মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেলো। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছু লেখা জোখা ছিলো শেখ মুজিবের অনন্য লীডারশীপের ওপর ( যা বাংলাদেশ অবজারভারে ছাপা হয়েছিলো।) । ভয়ে আতংকে, সে সব কাগজপত্র ছিড়ে ফেলে দিলাম।
এভাবে সাজানো গোছানো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেভাবে আছে সেভাবেই থাকলো, হলো লন্ডভন্ড। রোদ্রে খা খা করছিলো। কোন লোক , যানবাহন নেই রাস্তাঘাটে । স্তম্ভিত সবাই ! নীলক্ষেত সড়কে বিদ্যুতের তারে বসে শুধু কিছু কাক কা কা করছিলো।
১৬ তারিখ বিকেলে টিভিতে দেখলাম খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্রপতি । সে মিটিং করছে । ক’ মাস পর দেখলাম আরো কতো কী। ৩ রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় ৪ নেতার মর্মান্তিক মৃত্যু, ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব । বড়ই বিচিত্র এদেশের মানুষ !
১৭ তারিখ বিধ্বস্ত মনে চাঁদপুর চলে এলাম । কয়েকদিন পর আবার ফিরে গেলাম ঢা বি তে।
তখন ঢা বি ক্যাম্পাসে কোন প্রতিবাদ মিছিল দেখিনি। জাতীয় পত্র- পত্রিকাগুলোও কেমন যেনো ভয়ে ভয়ে নিউজ ছাপতো। ক্যাম্পাস পুরোপুরি ঠান্ডা ছিলো বেশ ক’ বছর । এক বন্ধু বললো “১৫ তারিখ ভোরে একজন নেতাকে ( আ: রাজ্জাক, শরিয়তপুর) দেখলাম লুংগী আর গেঞ্জি গায়ে গামছা দিয়ে মুখও মাথা ঢেকে কলাবাগানে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে ছদ্মবেশে । পালাচ্ছে।তখনতো প্রাণের ভয়ে আ লীগের সবাই আত্মগোপনে ছিলো। কোথায় কিভাবে শেখ সাহেবকে কোথায় দাফন করলো, তাও যেনো রহস্যঘেরা ছিলো।
শুনেছি দেশের বাড়িতে দাফন হয়েছে । ধীরে ধীরে জানতে পারলাম ”পুরো মুজিব ডাইনাসটিকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে’’ । আপামর সবাই একেবারে ছিলো নিশ্চুপ । কোথায় ছিলো বুদ্বিজীবীরা, লেখক , নাট্যজন ও সিনিয়র সিটিজেনরা ও প্রখ্যাত নির্ভীক সাংবাদিকগন!
আসলে সবাই যেনো ছিলো গুহায় পলাতক । বড়ই দু:খজনক ও মর্মান্তিক! বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। তা নাহলে আজ দেশের ভাগ্যে কী হতো ! আওয়ামী লীগেরই অবস্থা কী হতো !
সে যাক ১৫ আগষ্টের পরে অনেক মাস চলে গেলো, তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি , বলে্ওনি চলুন একটা প্রতিবাদ মিছিল করি। এব্যাপরে দেশের কোথায়ও কোন মামলাও হয়নি। সাহস করে কেউ মামলাটি করেওনি। অবাক কান্ড!
আজ এতো বছর (৪৮ বছর) পরও ঢা বি’ র সেইদিনের হ্বদয় ভেদ/ছেদ করা স্মৃতিগুলো মানসপটে ভেসে উঠে। তখনই মনটা বিষন্নতায় আচ্ছন্ন থাকে । কাউকে কিছু বলতে পারি না সেই অনুভূতি ও স্মৃতি গুলো। তাই কম্পিউটারের/ ফেইস বুকের আশ্রয় নিলাম। অপ্রকাশিত কথা ও অনুভূতিগুলোর কিছুটা ভেনটিলেট করলাম।
মহান আল্লাহ বংগবন্ধু ও তারঁ পরিবারবর্রগের সবাইকে মাফ করে জান্নাতি করুন, আমীন। মাফ করে জান্নাতি করুন জাতীয় চার নেতাদেরকেও । এসব পাহাড়সম দু:খ সহ্য করার শক্তিও দিন পরিবারের সবাইকে । আমীন।নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ।
এসব শোককে শক্তিতে রুপ দিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই উত্তম।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক । জয় বাংলা।
লেখক: অধ্যাপক দেলোয়ার আহমেদ, সাবেক অধ্যক্ষ পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর সদর ।
আজীবন সদস্য, ঢাবি এলামনাই এসোসিয়েশন, ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চাঁদপুর
১৫ আগষ্ট ২০২৩,