চাঁদপুর: চলতি মাসের ৩ আগষ্ট সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হয়। এর মধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার আপন দুই বোন গুলে জান্নাত সুমি ও জান্নাতুন নাঈম খুশবু, মতলব উত্তর উপজেলার আয়েশা আক্তার লাবনী, মতলব দক্ষিণ উপজেলার মুমু পোদ্দার ও সদরের শারাবান তাহুরা শিফা সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। এর মধ্যে আপন দুই বোনের সফলতা খুবই প্রশংসা পাচ্ছে।
সুমি ও খুশবু:
তাদের বাড়ি হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন মকিমাবাদ ৪নম্বর ওয়ার্ডে। গুলে জান্নাত সুমি শিক্ষা ক্যাডারে ও জান্নাতুন নাঈম খুশবু কৃষি ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। এই দুই বোন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. এয়াকুব মিয়া ও গৃহিণী রুপিয়া বেগমের মেয়ে।
তাদের বিষয়ে হাজীগঞ্জ মডেল সরকারি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক মোশারফ হোসেন জসিম জানান, তাঁরা দুই বোন আমাদের কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁদের এই ধারাবাহিক সাফল্যে উচ্ছ্বসিত।
গুলে জান্নাত বলেন, আমার শৈশব ও বেড়ে উঠা চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে চট্রগ্রাম থেকে নিয়মিত ঢাকায় গিয়ে চাকরির পরীক্ষা দেওয়া কষ্টকর। তাই মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে ঢাকায় চলে যাই। সেখানে পরিবারের ওপর চাপ কমানোর জন্য এবং একই সঙ্গে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আঞ্জুমান মোখলেছুর রহমান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে জুনিয়র ইনস্টাক্টর পদে যোগ দিই। সেই সঙ্গে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন কোর্সে ভর্তি হয়ে শিক্ষা বিষয়ক পড়ালেখা শুরু করি। চাকরি করার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি।
২০১৬ সালে প্রথম ৩৮তম বিসিএস দিয়ে আমার বিসিএস যাত্রা শুরু হয়। ৩৮তম বিসিএসে আশানুরূপ ফল না পেয়ে স্বপ্নপূরণের জন্য পুনরায় নতুন উদ্যোমে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। এভাবে দেখতে দেখতে ৪০তম বিসিএসের ফলাফলের দিন চলে আসে। সেখানে নাম না দেখে হতাশায় ভেঙে পড়ি। এ বিসিএসের ফলাফলে নিজের রোল আছে নন-ক্যাডার তালিকায়। ৪০তম বিসিএস থেকেই নন-ক্যাডার নিয়োগে নতুন করে জটিলতা শুরু হলে আমারও শুরু হলো আর এক অসহনীয় কষ্টের যাত্রা। ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিনের পর দিন উৎকণ্ঠা আর তার ফলে রাতের পর রাত কেটেছে নির্ঘুমে। চোখের জলও যেন মনে হচ্ছিল ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে ৩ আগস্ট সারাদিন অপেক্ষার পর যখন ফলাফল তালিকায় দুই বোনের রোল নম্বর একই সঙ্গে দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। ২০১৬ সালে শুরু শুরু হওয়া বিসিএস’র স্বপ্ন ২০২৩ এসে তা পরিপূর্ণতা পায়। এ জন্য সর্ব প্রথম মহান আল্লাহ তায়ালা ও পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ।
জান্নাতুন নাঈম বলেন, ২০১১ সালে হাজীগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি, ২০১৩ সালে হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচসএসসি পাস করি। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করি।
শারাবান তাহুরা শিফা:
চাঁদপুর সদরের মেয়ে শারাবান তাহুরা শিফা। তিনিও বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে তৃতীয় হয়ে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। সদরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের সনামধন্য আবু সা’দাত মৌলভী বাড়ির শওকত আলী মিয়া ও মনোয়ারা বেগম মিনুর দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
২০১১ সালে চাঁদপুর সদরের বহরিয়া নুরুল ইসলাম হাইস্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজ জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন শিফা।
এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৩.৭৪ সিজিপিএ নিয়ে সম্মান ও সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর (৩.৭৫ সিজিপিএ) শেষ করেন। বতর্মানে তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষগতা করছেন।
শিক্ষগতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান শারাবান তাহুরা শিফা। নিজের সাফল্যের প্রতিক্রিয়ায় শিফা বলেন, একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে মানবসেবায় কাজ করতে চাই। দেশকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চাই।
মেয়ের এই সাফল্যে খুশি শিফার বাবা-মাসহ গোটা বাড়ির স্বজনেরা।
মুমু পোদ্দার:
জেলার ঐতিহ্যবাহী শিশু সংগঠন মতলব সূর্যমুখী কচি-কাঁচার মেলার সাবেক আহ্বায়ক মুমু পোদ্দার এবারের বিসিএসে সহকারী পরিচালক (কৃষি বিপণন) সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। মুমু পোদ্দারের পিতা প্রয়াত খোকন পোদ্দার। মাতা চম্পা পোদ্দার। পেশায় একজন গৃহীনি।
তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ি মতলব পৌরসভার বোয়ালিয়া। বর্তমানে মতলব সদরের মতলব বাজারস্থ কলাদীতে বসবাস করছেন।
মুমু পোদ্দার কচিকাঁচা প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডেন এপ্লাস ও মতলবগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকেও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ঢাকাস্থ হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ ৫ পেয়েছেন। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
মুমু পোদ্দার এ ফলাফলের জন্য সকলের কৃতজ্ঞতা, দোয়া ও আর্শিবাদ কামনা করেছেন।
আয়েশা আক্তার লাবনী:
স্বামীর প্রবল ইচ্ছে, অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসায় সাফল্যের চূড়ায় লাবনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ১২-১৩ সেশনের আয়েশা আক্তার লাবনীর কথা। স্বামীর অনুপ্রেরণায় সদ্য ঘোষিত ফলাফলে বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন।
মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার উত্তর সিকিরচর গ্রামের সন্তান লাবনী। বাবা আবদুল খালেক মিজি ও মাতা তাসলিমা বেগম। পরিবারের দুই ভাই-বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। ছোট ভাই তাইজুল ইসলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে অধ্যয়নরত।
লাবনী পড়ালেখা শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের পাগলার আহসান উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনার ফলাফল ছিলো তার সবসময় চোখ ধাঁধানো। ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫। এরপর ভর্তি হন দনিয়া কলেজে। একাদশ শ্রেণিতেও ভালো ফলাফলের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ২০১১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়ে একই বোর্ডের অধীনে বৃত্তি পান লাবনী। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে প্রথম শ্রেণিতে ২০১৬ সালে স্নাতক ও ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল ইউনিয়নের পূর্ব লালপুর গ্রামের নাজির সাহেবের বাড়ির মো. রফিকুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ্য ছেলে মো. ফকরুজ্জামান আরিফের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন আয়েশা আক্তার লাবনী। আরিফ দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সুনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। হাজারো ব্যস্ততায় সবসময় স্ত্রীকে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন তিনি।
স্বামীর অনুপ্রেরণার কথা বলতে গিয়ে লাবনী বলেন, যেকোনো সফলতায় একজন বন্ধু পাশে থাকা দরকার। সে দিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান। কারন আমার স্বামী আগে আমার বন্ধু তারপর স্বামী। তার সবসময় বিশ্বাস ছিলো একাডেমিক সফলতার পাশাপাশি বিসিএসে ভালো করতে পারব। তার এই বিশ্বাস আমার আত্মবিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে দিতো। আমার আজকের এই সফলতায় তার অবদান অনস্বীকার্য।
ফম/এমএমএ/