
প্রতিকী ছবি।
যুবক অনার্য ।। গলিটা এখানে এসে শেষ হয়ে গেছে।
নিকটেই রেললাইন। লাইনের পাড় ঘেঁষে মজা নর্দমা।উপরে বিলুপ্ত সাঁকোর পদচিহ্ন।রাখাল তাকিয়ে আছে।ওর চোখ ক্লোজ সার্কিটের মতো ঘুরছে।
দুয়েকদিন আগে সাঁকোটির পদচিহ্নে একজন খুন হলো।কেউ বলে দলীয় খুন।কেউ – ‘রাজনৈতিক’। ‘ নারী বিষয়ক নিষিদ্ধ গন্ধ’ বলে কেউ কেউ।
রাখালের বাম চোখটা একটু ফুলে আছে।রাতে ঘুম হয় নি।অথবা হয়েছে- সে পারছে না নিশ্চিত হতে।হওয়া সম্ভবত জরুরি নয়, যেমন জরুরি নয় জানা- রিতুর ক্ষরণ হবে ঠিক কতো তারিখে।তবু সে একবার জেনে নিয়েছিলো জিজ্ঞেস ক’রে ওর পেইন হবার কারণ এবং কবে পেইন হবে পুনরায়।
বলেছিলো রিতু : জেনে কি হবে?
বলেছিলো রাখাল: কিছুই হবে না।
বলেছিলো তারপর : একজন সোমত্ত রমণীর ২৮ দিনে ক্ষরণ হয় একবার।আর এই রাষ্ট্রটির ক্ষরণ হচ্ছে প্রতিদিন।কারা কারা প্রতিদিন করছে রক্তাক্ত করছে প্রতিদিন রেইপ।হায় রে জননী আমার।
-ওসব ভারী কথা আমি বুঝি না।আমাকে হালকা কিছু বল।
:আজ পারবো না। অন্যদিন।
-অন্যদিন আসবে না কোনোদিন!
:আসবে।আসতেই হবে।নবজাতকের তীব্র কান্নার মতো করে। যাইহোক, তুই বাসায় চলে যা।বিল্লুর ঠেকে আমার একটু কাজ আছে।
বিল্লুর ঠেকে কাউকে পাওয়া গেলো না।বিল্লুটা টাল হয়ে আছে।রাখালকে দেখে জড়ানো গলায় গাইতে শুরু করলো- ‘মদিরা স্বপনে রঙিলা বসনে…’
:বিল্লু
-আজ্ঞে কত্তা
:নাঙ্গাকে বলিস- আজ কোনো বিলাই আসবে না।
বিলুর উত্তর- ‘ মদিরা স্বপনে রঙিলা বসনে…’
বিলাই আসার মানে কী – বিল্লুটা কখনো জানতে চায়নি।জানতে চায়নি- কাউয়া থ্রি পিছ টিকটিকি মিডা রাইত ইত্যাদি আসা না আসার মানে – কোনোদিন।
এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না ।রোদ চড়ে উঠেছে।রাখাল কিছুক্ষণ কী ভেবে ডানদিকের গলি দিয়ে ঢুকে প্রধান সড়কে নেমে এলো।বেলা ২ টার মধ্যে যেতে হবে নাইক্কারঘাট,চিনুদার কাছে।একটা রিক্সায় উঠে পড়লে ৪৫ মিনিট।
দরোজা খুলে দিলো লুনি।১২/১৩ বছর বয়স থেকে এ বাড়িতে আশ্রিতা।লুনিকে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ ভালো আছে। এরকম কেনো মনে হয় , তা রাখালের কাছে অজানা।লুনি ভেতরে যাবার ৫ মিনিট পর চিনুদা এলেন।ঘরের দেয়ালে ঝুলে আছে ম্যানডেলা মার্কস ফিদেল চে….
চিনুদা কর্ণারে সিঙ্গেল সিটে বসলেন।৭ মিনিট পর চা দিয়ে গেলো লুনি যার চেহারায় ফুটে থাকে একটি সুখী বাংলাদেশ।
চিনুদার ‘হয়ে ওঠা’ নব্বইয়ের দশকে। নব্বইয়ের দশক নিয়ে আমাকে একটি স্পষ্ট ধারণা চিনুদা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন- ‘বাবা চলে গেলেন অকালে।৮০ দশকের বাংলাদেশ নিয়ে বাবার কাছে প্রত্যক্ষ ধারণা পাওয়া যেতো। হলো না।তার আগেই স্ট্রোক করলেন।’
দেশলাই জ্বেলে সিগ্রেটে একবার টান দিয়ে চিনুদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে।এভাবে মিনিমাম ৭/৮ মিনিট তাকিয়ে থাকবার পর কথা বলেন চিনুদা।আজ আমিই শুরু করলাম।
: চিনুদা
-বল
ভাবছি জিতুকে না করে দেবো।
-কেনো?
:ওর খুব শীঘ্রই চাকুরী আয় রোজগার দরকার।সংসারে বাবা নেই।এতোদিন সেতু আপু চালিয়ে নিয়েছেন।বিয়ের পর আর ওভাবে সম্ভব নয়।তাই ভাবছিলাম না বলে দেই কিন্তু ওর এসব করার ইচ্ছে প্রবল।
-রাখাল, জিতুকে নয় শুধু, আপাতত সবাইকে একটু অফ থাকতে হবে।আমাদের কন্সেপ্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চলে গেছে।সময়টা তুমুল বদলে গেছে।আগের মতো কোনো কিছু নেই।যা কিছু হচ্ছে টুকটাক বিচ্ছিন্ন প্রয়াস।এসবে এখন পজিটিভ কিছু আসবে না।সময়টাকে বুঝতে হয়।বুঝতে পারে খুব কম সংখ্যক।
চিনুদাকে বলার মতো তাত্বিক কিছু আমার জানা নেই।
:দাদা, সময়টাকে আরও বদলে দিতে চাই, তবে অন্যভাবে।
-সময়কে বদলে দিতে হলে বিবর্তনকে প্রভাবিত করবার থিসিস এন্টিথিসিস এমনকি জেনে নিতে হবে সিন্থিসিস।যেমন ধর ফিতা ক্যাসেট গিয়ে এলো সিডি তারপর ব্লুটুথ ইউটিউব।যারা এই কনভার্টেড ধারার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পেরেছে তারাই টিকে গেছে, বাকিরা মার্কেট আউট।- এটা অবশ্য মামুলি চলতি আর সস্তা উদাহরণ। মূল বিষয়টা অন্য জায়গায়।
আমি যে চিনুদার দিকে আরেকটু সিরিয়াস ভঙিমায় দু’চোখ তীর্যক করে দি, চিনুদা বুঝতে পারেন।
-রাখাল, তুই আবেগ দিয়ে ভাবছিস দেখছিস।তোর ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে এমন ইতিহাসও আছে – একটি সমগ্র জাতি একটি ভূখন্ড বা একটি বিশেষ মনস্তত্ত্ব নিয়ে প্রথম যিনি ভেবেছেন,তার নাম মানুষের কাছে অজানা থেকে গেছে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর।
আমি চিনুদাকে মাঝপথে বাধা দিয়ে কিছটা যেনো অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বলি
: বেলাদি কাল ফোন করেছিলো। জানতে চেয়েছিলো- দিদি এখন কী সিদ্ধান্ত নেবে।
চিনুদা একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে বললেন- অঞ্জনদা’র গানে বেলাকে বলা হয় চাকরি পেয়ে যাবার সংবাদ।আমি অঞ্জন দত্ত হতে পারি নি।কী আর বলবি।বলিস প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে।
সিগ্রেটে টান।ধোঁয়া।৭ মিনিটের নীরবতা। নীরবতা ভঙ্গ হলো।
-রাখাল
:দাদা
-জানি, হতাশ হচ্ছিস।ভাবছিস দাদা তো হাল ছেড়ে দেবার লোক নয়,তাহলে এসব কেনো বলছেন- তাইতো?
আমার মুখে অগত্যা কাষ্ঠহাসি।
-শোন, আমাদের এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সিদ্ধান্তের সময়।আপাতত ব্যক্তিজীবন নিয়ে ভাবতে পারছি না।জানি বেলা সহজ মেয়ে নয়।তুই বললেও সে তার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।না হয় চালাতে দে।এর বেশি কিছু, অন্যকিছু কী হতে পারে আমি সত্যিই জানি না।
চিনুদা আর বেলাদির জন্য আমার শিরা-উপশিরায় কিংবা কোথাও চিনচিন করে ওঠে।
লুনি এসে বলল- দাদা, তোমার ফোন।
চিনুদাদের বাদায় এখনো ল্যান্ডফোনের লাইন আছে।বাবার স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে।
আমি উঠবার জন্য উঠে যাবার প্রসঙ্গে আসতেই দাদা বললেন – আমি বলার আগে কিছুদিন বিল্লুর ঠেক এড়িয়ে চলিস।
আমি ‘ ওকে, দাদা’ বলে উঠে পড়লাম।লুনি ভেতর দরোজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো।ওর মুখে ফুটে আছে সেই সুখী বাংলাদেশ।
*** *** ***
চোখের সমুখে সবকিছুই বদলে গেলো।রেললাইনের পাড়ে মজা নর্দমা আর নেই, ওখানে একটি শপিং মল দাঁড়িয়ে আছে তিনতলাসম উঁচু হয়ে।এ পাড়ায় বেশিরভাগ ছিলো সেমি দালান টিনশেড; এখন রাখালদের বাড়ি ছাড়া আরও দুটি মাত্র বাড়ি টিনশেড,বাকি সব বহুতল দালান।মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে কী বিশাল পরিবর্তন। শুধু কি রাখালদের এলাকা, পুরো শহরটাই তো আর আগের মতো নেই।আসলে এটাইতো স্বাভাবিক। তবু আগের সেই পুরনো পাড়াটাকেই রাখালের ভালো লাগে,সেই যে বাবা মার হাত ধরে ৫ বছর বয়সে র্যাংকিন স্টিট থেকে সে চলে এসেছিলো আধা গ্রাম আধা শহর আধা মফস্বল এই চরপাথালিয়া এলাকায়।এখন এটি আর সেই নামে নেই।এখন বলতে হয় অমুক ব্লক তমুক লেন।পাড়া বলে কিছু নেই।
কিছুদিন পর বইমেলা।মেলাও সরে এসেছে মূল একাডেমি ভবন থেকে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে।
মেলার কথা মনে পড়লেই কবিতা মনে পড়ে।মনে পড়ে গান নাটক আরও কতো কিছু।মনে পড়ে – ” নেতা ভুল নারী ভুল বাগানে নষ্ট ফুল অকথিত কথার বকুল।”
সেই কবেকার কবিতা।আজও বড় সত্যি।রাখালের মনে পড়ে- সেদিন নাইক্কারপাড় চিনুদা’র বাড়ি থেকে এসে বিকেলে চাট্টে খেয়ে রাখাল ঘুমিয়ে পড়েছিলো।পরদিন সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দিলো চিনুদা’র সর্বসাম্প্রতিক দিকনির্দেশনা। সেই মোতাবেক রাখালরা সতর্ক হয়ে গেলো।সপ্তাখানেক পর রাখাল চিনুদা-কে ফোন দিলো।ল্যান্ডফোনে বলা হলো- চিনুদা বাড়ি নেই।এভাবে মাসখানেক ল্যান্ডফোনে- ‘ চিনুদা বাড়ি নেই’ – শুনে রাখাল আর ফোন দেয়নি।বছর খানেক চিনুদা’র কোনো খবর না পেয়ে রাখালের কাছে চিনুদা বিষয়টি কিছটা স্তিমিত হয়ে আসছিলো।একদিন অনেকদিন পর রনোর সঙ্গে দেখা।রনো জানালো- চিনুদা দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন।
একদিন অনেকদিন পর জিতুর সঙ্গে দেখা। বলল- চিনুদা কক্সবাজার চলে গিয়েছিলেন।ওখানে এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসায় করতেন।
ঘটনা সত্য কিনা রাখাল নিশ্চিত হতে পারেনি।তবে একদিন কিছুদিন পর নিশ্চিত হলো – চিনুদা আপোষ করে সরে গিয়েছিলো।বেলাদিকে বিয়েও করেছিলো।তাদের একটি বাবু আছে।ভরপুর সংসার।
কেউ কেউ বলতো – মজা নর্দমার উপরে বিলুপ্ত সাঁকোর পদচিহ্নে যে খুনটি হয়েছিলো তার সঙ্গে চিনুদার যোগসাজশ ছিলো।
রাখাল মনে মনে বলে : চিনুদা তুমি সত্যিই অঞ্জনদা হতে পারো নি।2441139 নম্বরে কাঁদছিলো অঞ্জনের বেলা বোস কিংবা বেলা নয়,কাঁদছিলো হয়তো অন্য কেউ কারণ চাকরিটা পেতে অঞ্জনদা’র বড্ড দেরি হয়ে গেছিলো।বেলা বোসকে অঞ্জনদা পাননি।তুমি কিন্তু বেলা রায়কে ঠিক ঠিক পেয়েছিলে।
তারপর রাখালের মনে পড়লো লুনির কথা যে মেয়েটির মুখে বাংলাদেশ ফুটে থাকতো মিথ্যেভাবে সুখী হয়ে।আচ্ছা, লুনি এখন কোথায় আছে কেমন আছে- লুনিকে রাখালের খুব দেখতে ইচ্ছে হলো।রাখাল দেখলো- তিনটি মাঝিচিত্র অথবা তিনটি নদীচিত্র অথবা তিনটি নৌচিত্র।প্রথম নৌকায় কোনো মাঝি নেই বৈঠা নেই।দ্বিতীয় নৌকায় বৈঠা আছে মাঝি নেই। তৃতীয় নৌকা মাঝি ভাসিয়ে দিয়েছে মাঝ দরিয়ায়।যাত্রীদের নিজস্ব গন্তব্য আছে কিন্তু সেই গন্তব্যের সঙ্গে মাঝির বৈঠা বাওয়ার কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে না নিরীহ যাত্রীগণ।
*** *** ***
এইখানে গলিটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো।নিকটেই রেললাইন মজা নর্দমা উপরে বিলুপ্ত সাঁকর পদচিহ্ন।একটি খুন হয়েছিলো।কেউ বলেছিলো- দলীয়। কেউ- ‘রাজনৈতিক’। নারী বিষয়ক নিষিদ্ধ গন্ধ পেয়েছিলো কেউ কেউ।