দীর্ঘ কয়েকবছর পর গত গ্রীষ্মে টানা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছিল দেশ। প্রথমে সিডিউলভিত্তিক লোডশেডিং দেওয়া হলেও দিনের অর্ধেক সময়ই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটাতে হয় সাধারণ মানুষকে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে এ পরিস্থিতি হয়ে উঠে ভয়াবহ। সেখানে ৫-৬ ঘণ্টা পর পর একবার করে বিদ্যুৎ আসত কয়েক মিনিটের জন্য। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছিল। কিন্তু আসন্ন গ্রীষ্মে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মার্চের গরম, রমজানের অতিরিক্ত বিদ্যুতের ব্যবহার, সেচের জন্য ব্যবহৃত বাড়তি বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ চাহিদা মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত চলতে থাকবে। কিন্তু এর বিপরীতে বিদ্যুতের সংস্থান রয়েছে টেনেটুনে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর ২ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি লোডশেডিং করতে হতে পারে। গতবছর এ রকম লোডশেডিংয়েও জনগণকে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। এ বছর তাহলে কি পরিস্থিতি হবে তা নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াটের মতো। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়ে মার্চের শুরুতেই এই চাহিদা এক লাফে গিয়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজারে পৌঁছাবে। রোজা এবং কৃষকদের সেচ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এই চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটেও পৌঁছাতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় সর্বোচ্চ উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ। এর সঙ্গে ভারতের আদানি গ্রুপের উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট মার্চে জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে।
এর বাইরে কয়লা আমদানির ধারাবাহিকতা সাপেক্ষে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসতে পারে সাড়ে ৮শ’ থেকে ৯শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসতে পারে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট। আর মাতারবাড়ি ও বরিশালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবমিলিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনসহ এসব বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আরও ৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ যোগ হতে পারে।
কিন্তু এর পরও ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাবে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, গতবছরের গ্রীষ্মে আমাদের চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি ছিল দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট। ওই সময় একেক দিন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১২ হাজার সাড়ে ১২ হাজারের মতো। ফলে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি ছিল ১৩শ’ থেকে ১৪ মেগাওয়াট পর্যন্ত। কিন্তু আসন্ন গ্রীষ্মে এই হিসাব আরও বাড়বে। তিনি বলেন, মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে প্রতিদিনই। আমাদের শিল্প-কারখানাগুলোও পুরোদমে চলছে।
এলএনজি আমদানি শুরুর প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও উৎপাদনে ফিরেছে। এতে করে মানুষের মধ্যে সাশ্রয়ী মনোভাব উধাও হয়ে গেছে। ফলে আসন্ন গ্রীষ্মে আমরা মনে করছি বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটে পর্যন্ত উঠতে পারে। এই ঘাটতি মেটাতে লোডশেডিংয়ের কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।
২ হাজার মেগাওয়াটের চাইতে কম লোডশেডিংয়েই গতবছর জনগণকে যে পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এ বছর যদি তার বেশি লোডশেডিং হয় তাহলে পরিস্থিতি কি হবে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, যেহেতু বিশ্বজুড়েই একটা সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেই কারণে গতবছর একটা নির্দিষ্ট সময় আমাদের লোডশেডিং করতে হয়েছে। তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিংও কমে গেছে। তবে এই সময়টায় আমরা চেষ্টা করেছি গ্যাস ও বিদ্যুতের বিকল্প সংস্থানের।
ইতোমধ্যে এলএনজি আমদানি পুনরায় শুরু হয়ে গেছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও উৎপাদনে আসছে। একইভাবে ভারতের আদানির বিদ্যুৎও আসবে আগামী মাসেই। কয়লা আসায় রামপালও আবার উৎপাদনে ফিরেছে। পায়রার বিদ্যুৎও যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। বরিশাল-মাতারবাড়ির বিদ্যুৎও গ্রীষ্মে পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে আশা করছি সংকট ততটা হবে না। তবে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সাশ্রয়ী হওয়ার কথা বলে আসছেন তাই আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। এর বিকল্প নেই।
পিডিবি বলছে, দেশে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে গ্যাসচালিত ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল চালিত ২৫ দশমিক ২ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ১১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ডিজেলচালিত ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি অব্যাহত থাকলেও সংকট খুব বেশি হবে না বলে দাবি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে মাসে গড়ে অন্তত ১২৫ কোটি ডলার লাগে। বিশ্ববাজারে এলএনজি, কয়লার দাম কিছুটা কমতির দিকে। গ্রীষ্মে আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি আছে। ইতোমধ্যে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হয়েছে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ ডলারের জোগান। তাহলেই সংকট গতবছরের মতো তীব্র হবে না বলে আমরা মনে করছি।-খবর জনকন্ঠ অনলাইন।
ফম/এমএমএ/