
।। এস ডি সুব্রত।। যে ব্যক্তি মানুষের জীবনের যুদ্ধ সংঘাত আর আনন্দ বেদনায় নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের বৃহৎ ক্যানভাসে তিনি হলেন বাঙালির হদয়ের মানিক সত্যজিৎ রায়।দেশ মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলচ্চিত্রে র রুপালি ফিতায় নিজের অনুভূতি কে তুলে ধরে সত্যজিৎ রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন বিশ্ব দরবারে। একবার কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপক যখন ক্লাসে ঢুকেন , ছাত্ররা তখন উঠে দাঁড়িয়েছিল তটস্থ হয়ে ।
সেই সময় অধ্যাপক একজনকে বললেন, তুমি বেঞ্চের উপর দাড়িয়েছ কেন? ছাত্রটি তখন তটস্থ হয়ে জবাব দিয়েছিল , না স্যার,আমি বেঞ্চে না মেঝেতেই দাঁড়িয়েছি। তখন অধ্যাপক ভালভাবে তাকিয়ে সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার সত্যজিৎ রায়কে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলেটি তার শারীরিক উচ্চতা ছাপিয়ে কর্ম আর মেধায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব দরবারে। নিজের সাথে সাথে বাংলা ভাষা আর বাঙালি কে যিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায় , তিনি হলেন সত্যজিৎ রায়। ছোটবেলায় তার ডাক নাম ছিল মানিক। এই মানিক একদিন হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির হদয়ের মানিক। যার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, আগন্তুক কিংবা ফেলুদার নাম তিনি হলেন সব দেশের সেরা চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও শিল্পী। যাদের নিয়ে বিশ্বসভায় বাঙালি জাতি গর্ব অনুভব করে তাদের মধ্যে অন্যতম সত্যজিৎ রায়।২ মে তার জন্ম শতবর্ষ।
১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। বাবার নাম সুকুমার রায় এবং মার নাম সুপ্রভা দেবী । উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন তার পিতামহ। তার পূর্ব পুরুষের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কিশোর গঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে।জন্মের পর তাকে ডাকা হয়েছিল প্রসাদ নামে।মা ডাকতেন মানিক।ছোটকাকা নাম রেখেছিলেন নুলমুলি ।মানিক নামটাই তার সাথে যেন মানান সিং। যেখানে হাত দিয়েছেন ,সেটাই হয়ে উঠেছিল মূল্যবান মানিক।
ছেলেবেলায় হারান বাবা বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় কে। বাবা সুকুমার রায় কে তিনি চিনেছেন তার লেখা ও আঁকা র মধ্য দিয়ে। তার দাদা বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কে চিনেছেন তার কর্মের মাধ্যমে।
তার প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল মায়ের হাতে।১৯২৯ সালে বালিগঞ্জ সরকারি স্কুলে শুরু হয়েছিল তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।১৯৪০ সালে বিএ অনার্স পাস করেন।১৯৪০ সালে মায়ের আগ্রহে শান্তি নিকৈ কলাভবনে ভর্তি হন সত্যজিৎ। ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ডি জে কেমার নামক বিজ্ঞাপন সংস্থায় জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার পদে চাকৈ পান ৮০ টাকা বেতনে।এসময় সত্যজিৎ নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন।১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় ও বংশী চন্দ্র গুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট জন্য বানিজ্যিক ইলাস্ট্রেটর হিসেবেও কাজ করছেন। সত্যজিৎ যখন নিজের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী পরিচালনা র সিদ্ধান্ত নিলেন তখন নতুন বলে প্রযোজক পাননি।
১৯৫২ সালের শেষের দিকে নিজের টাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন।১৯৫৫ সালে ভারতের তৃতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এটি শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং সেরা বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয় ।পরে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট এবং ওসিআইসি পুরস্কার জিতে নেয়।২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রে স্থান পায় । ১৯৬৭ সালে ফিলিপাইনে র রামন ম্যাগসেসে পূরস্কার পান।১৯৬৯ সালে সবচেয়ে বানিজ্যিক ভাবে সফল চলচ্চিত্র মিউজিক্যাল ফ্যান্টাসি গুপি গাইন বাঘা বাইন।১৯৭৪ সালে লন্ডনের রয়েল আর্ট কলেজ তাকে চলচ্চিত্রে র জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
১৯৭৮ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে র আয়োজক কমিটি তাকে সর্বকালের সেরা তিন জন পরিচালকের মধ্যে তাকে স্থান দেন।১১ তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তার অশনি সংকেত সিনেমার জন্য বিশেষ সম্মান সূচক পুরস্কার দেয়া হয় বিদেশের মতো নিজ দেশ ভারতে পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরত্ন পুরস্কার। এছাড়াও সত্যজিৎ রায় ছিলেন সুরকার এবং একজন লেখক।
বিশ্ববিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন …. ” পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা না দেখা মানে পৃথিবী তে বাস করে চন্দ্র সূর্য না দেখা” । কেউ কেউ বলেন , বাংলা ভাষায় কথা বলেও তারা ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু কে চেনে না তারা নির্ভেজাল আনন্দ থেকে বঞ্চিত। সত্যজিৎ রায়ের ছবি আঁকা দেখে তার ড্রয়িং টিচার আশু বাবু বলতেন সত্যজিৎ নামেও সত্যজিৎ ,কামেও সত্যজিৎ। ছোটবেলার মানিক সেতো সত্যিকারের মানিক হয়েই থাকবে বাঙালিদের তথা বিশ্ববাসীর হৃদয়ে। মৃত্যু বরন করেন ২৩ এপ্রিল ১৯৯২ সালে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ
০১৭৭২২৪৮২২৪
sdsubrata2022@gmail.com