।। ভাস্কর ডি.কে. দাশ মামুন ।। বাংলার হাজার বছরের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিশাল অংশ জুড়ে আছে লোকজ ধারার অপার ঐশ্বর্য্যরাজী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই বৈভবপূর্ন স্বত্তার সামগ্রীর একটি বড় অংশ নিত্য ব্যবহার্যে লোকমুখে সচরাচর ব্যবহৃত হলেও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনাদর অবহেলায় বহু কিছু কালের গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে, এমনকি সময়ের সাথে হারিয়েও গেছে কত অমূল্য লোকজ সাহিত্য, শিল্প সম্ভার, সামগ্রী। সে সব পুনরুদ্ধারের জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকুল প্রচেষ্টায় যে কতজন লোকশিল্প লোকসাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ অগ্রণী ভুমিকায় অবতীর্ণ তাঁদের অন্যতম আচার্য ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। অকল্পনীয় ও সাধ্যাতীত শ্রম, মেধা ও মননশীলতা সর্বোপরি পূর্ণ প্রণোদনায় বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে ঘুরে ঘুরে দীনেশ চন্দ্র সেন উদ্ধার করে এনে জড়ো করেছেন লোকসাহিত্যের অমুল্য হীরে জহরতে।
সেই বদান্যতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস অসম্পুর্ণ হতে বাধ্য যদি আমরা কোনদিন আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনকে ভুলে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় পঠন-পাঠন পর্যায়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তিনি একজন স্থপতি। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শুভারম্ভ ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে’র জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বৃটিশ শাষিত পরাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠার গৌরব অবশ্যই প্রাপ্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। যে জন্য তাঁর মর্মরমূর্তির পাদদেশে লেখা হয় “ ঞযব ঢ়ষধপব ড়ভ যরং সড়ঃযবৎ রহ ঃযব ংঃবঢ়-সড়ঃযবৎং ঐধষষ.” এরই উদ্যোগে ও আহবানে দীনেশচন্দ্র যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা আজ দেড়শ বছর ছাড়িয়ে যাওয়া গৌরবময় ইতিহাস। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে পরীক্ষকরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন তিনি চেয়েছিলেন। ১৯০৯-এ তাঁকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর তিনি ‘রীড়ার’ রূপে নিযুক্ত হন। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক। এসব দীনেশ চন্দ্র সেনের একাডেমিক কর্মকান্ডের বিষয়। সেই নিরিখে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মকর্তা হিসাবে সফল ব্যক্তি তিনি।
কিন্তু দীনেশচন্দ্র কেবল এজন্যই স্মরণীয় নন। তাঁকে বাঙালি মনে রেখেছে তাঁর বিপুল সংগ্রহ,সৃষ্টির মহত্ত্বে ও মহিমার জন্য। বিশেষভাবে তাঁর অমর সৃষ্টি “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য”(১৮৯৬) যা ভাষা ও সাহিত্যের যথাযথ ইতিবৃত্ত। তাঁর যে আগে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হয়নি এমন নয়।
বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বাঙালির জীবনে আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের আবির্ভাব এক পরম গৌরবের বিষয়। বাংলা সাহিত্য ইতিহাস রচনা যজ্ঞের তিনিই যথার্থ অর্থে আদি পুরোহিত। বাংলা ভাষার সাহিত্য, ইতিহাস রচনার অস্ফুট প্রভাতে, কুয়াশামলিন অপ্রকাশ মুহুর্তে দীনেশ চন্দ্র প্রভাত সূর্যের আলোক রশ্মি বিকিরণ করলেন। বাংলার অবহেলিত উপেক্ষিত লোক সাহিত্যকে প্রাণের টানে হৃদয়ে সশ্রদ্ধায় প্রতিষ্ঠিত করে বাংলার ঘরে ঘরে তার রসপ্রবাহকে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রবাদ প্রতিম গীতিকা সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে দীনেশ চন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেছেন, “আমি শক্তিহীনের মত যতদিন বাঁচিয়া থাকিব, ততদিন গ্রীকে ভাস্করাচার্য ফিডিয়াসের মত স্মৃতি মনোমন্দিরে পূজা করিব।
সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি জেনে নির্ধারিত তার ঐতিহাসিক ধারনা। সারা বিশ্বে প্রাচীন এই ভাষার ইতিহাস ও ইতিহাস নির্ভর মুল্যায়ন যারা করেন তাঁরা অবশ্যই বিদ্যাতত্ত্বজ্ঞ বিশারদ।দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ সাহিত্য ইতিহাসকার। তার আগে বাংলা সাহিত্য ইতিহাস রচনার প্রস্তুতি ও প্রয়াস দেখা দিলেও তা পূর্ণাঙ্গরূপ পায়নি। দীনেশ চন্দ্রের “বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য” সেই প্রত্যাশা পুরনের প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। সাহিত্য নিয়ে যারা কাজ ত্রিমাত্রিক রূপরেখায় কাজ করেন তাদের কাছে গ্রন্থটি আকড় ধাঁচের উপযোগী গ্রন্থ।
বাংলা লোক সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে দীনেশ চন্দ্র দেখা দিয়েছেন রাজকীয় গৌরবে, জীবনাবেগের অতন্দ্র প্রাচুর্যে। রবীন্দ্রনাথের পর দীনেশ চন্দ্র সেনই প্রথম ব্যক্তি যিনি অদম্য উদ্যম ও আন্তরিকতায় লোকসাহিত্যের বিলুপ্ত অধ্যায় আবিস্কার করেন। বাংলার লোকসাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি অদম্য প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। ঊধংঃবৎহ ইবহমষধ ইধষষধফং-গু সবহ ংরহময (াড়ষ, ঢ়ধৎঃ ১) নামে দীনেশ চন্দ্র গীতিকা গুলিকে প্রকাশ করেন। এর বাংলা সংস্করণ “মৈয়মনসিংহ গীতিকা” প্রথম খন্ড দ্বিতীয় সংখ্যা নামে মুদ্রিত হয় ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে। প্রথম খন্ডের উল্লেখযোগ্য গীতিকাগুলি হলো-মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, কঙ্ক ও লীলা প্রভৃতি। পূর্ববঙ্গ গীতিকার দ্বিতীয় খন্ডে, দ্বিতীয় সংখ্যায় চৌদ্দ খানা গীতিকা স্থান পেয়েছে। তারমধ্যে-ধোপার পাট, মইষাল বন্ধু, কাঞ্চন মালা, ভেলুয়া উল্লেখযোগ্য। পূর্ববঙ্গ গীতিকার তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ডে মঞ্জুর মা, ভেলুয়া হাতীখেদা, আয়না বিবি, শীলা দেবী, মুকুট রায়, জিরালনী প্রভৃতি গীতিকার নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা লোক সাহিত্যের এই অমূল্য উপাদানে লোক আঙ্গিকের বিজয়, মৌলিক রূপরেখার রচনাকারীর সত্যিকারের হদিস মিলেনি।
মৈমনসিংহ গীতিকায় স্থান করে নেয়া পালাগুলো উদ্ধারে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে চষে বেড়িয়েছেন। আজও লোকমুখে শুনা যায় প্রত্যন্ত পল্লী-গ্রাম মস্কা, গোরালীর মত কত গ্রামে তিনি তাঁর গবেষণা কর্মের তাবু ফেলেছিলেন। লোকমুখে যে গীতিকার কাহিনীগুলো প্রচলিত ছিল তা তিনি ধৈর্য সহকারে শুনে শুনে বাণীবদ্ধ অত:পর লিপিবদ্ধ করে পা-ুনলিপি রচনা করেছিলেন। এ সমস্ত পা-ুলিপি ছাপার আগে বারে বারে সথকের (পরিবেশনকারী শিল্পী) বয়ানের সাথে মিলিয়ে নিয়ে অবিকৃতভাবে গ্রন্থগত করা হয়েছিল। তাতে যতিও মাত্রা চিহ্ন ব্যবহারে দীনেশ চন্দ্র সেনের মুন্সিআনা রয়েছে। একাধিক গায়ক এই গীতিকাগুলো পরিবেশন করতেন বলে তাদের নিয়েও তিনি পান্ডুলিপি রচনার পূর্বে সমন্বয় করেছিলেন এবং পূর্ণ অবয়বদান করে চুড়ান্ত সফলতা লাভ করতে পেরেছিলেন।
ড. দীনেশচন্দ্রের লেখা “ময়মনসিংহ গীতিকা (পূর্ব বঙ্গ গীতিকা) এক অপূর্ব শিল্প সৌকর্যম-িত মাধুর্য্যমন্ডিত গ্রন্থ। চার খন্ডে প্রকাশিত পুস্তকটি বাংলা লোক সাহিত্যের লোক উপাচারের অনন্য সম্ভার হিসেবে প্রত্যেক সাহিত্য প্রেমিককে আকর্ষন করে। পালাগুলো যেন বাঙালিদের মৌরশী অমূল্য সম্পদরাজী প্রস্তুকটি পদ্য ছন্দে রচিত। দীনেশ চন্দ্র বলেছেন, “ময়মনসিংহ গীতিকার আমরা বাংলা ভাষায় স্বরূপটি পাইতেছি।”
দীনেশ চন্দ্র সেন একদিকে ছিলেন লোকসাহিত্যের হৃদয় রথে জারিত এক অভুতপূর্ব শিল্প লেখক অন্যদিকে এক অক্লান্ত ও সুশৃঙ্খল ভাবে ধারণের অতন্দ্র সংগ্রাহক। তিনি জানতেন সেই শিক্ষিতেরা (শিক্ষিত যুবক) লোকসাহিত্য সংগ্রহ কার্যে নানাক্রটি-বিচ্যুতি করবে। কেননা লোক সাহিত্য গ্রামীন কিংবা আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। গুরুগম্ভীর ভাষা গ্রামীন সমাজে অনেকটা দূর্ভেদ্য। সর্গীয় পান্ডিত্য পূর্ন ভাষা এখানে অনেকটা অচল। দীনেশ চন্দ্র সেন সেইটুকু অনুভব করতে পেরেছিলেন।
“অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত লোকেরা পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষা বুঝেন না। কিন্তু তাহাদের অন্তরেও আনন্দ, বেদনা, প্রেম, বিরহ, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি ভাবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া,উচ্ছ্বাস বয়ে যায়। আনন্দ এবং দুঃখের আতিশয্যে (বীপবংং) কথায় সুব আসে, সেই সুরই গান ও বেদ, রাগ-বাগিনীতে ভরিয়াছিল। তাই তিনি নিরক্ষর চাষা, অর্ধ শিক্ষিত ভদ্রলোক যারা লোকগানের সমঝদার, তারাই এই কার্যের উপযুক্ত বলে ধারণা যেমন করেছিলেন তেমনিভাবে তা সঠিক বলে বিবেচিত হয়েছিল।
আচার্য্য দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার প্রবাদ পুরুষ। তার অদম্য সাহস, মনোবল আর প্রতিভা অনন্য ও অসাধারণ। “ তার বিদ্যাচর্চা বিলাস নয়, প্রাণের গভীর টান, জীবনের মহৎ তৃষ্ণা, মহাকালের সোনার তরীতে সোনার ধান তুলে দেওয়ার সৌভাগ্য সকলের হয় না।” যাদের হয় তারা পৃথিবীর মায়ের অমর সন্তান। দীনেশ চন্দ্র সেন পৃথিবী মায়ের সেই অমর সন্তান, অমৃতের পুত্র। কবির ভাষায়-“ এ পৃথিবী একবারই পায় তারে পায় নাকো আর।”
দীনেশচন্দ্র সেন যুগবিভাজন করে তাঁর ভাবনা ও বক্তব্যকে সুপরিস্ফুট করেছেন। যেজন্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ নামের গ্রন্থরচনা আসলে “ঞযব ফরংপড়াবৎু ড়ভ ড়ঁৎ খরঃবৎধৎু যবৎরঃধমব”. বিস্মিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য বলিয়া এত বড়ো একটা ব্যাপার আছে তাহা আমরা জানিতাম না।” বলা বাহুল্য দীনেশচন্দ্র অনেক বই লিখলেও “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ই তাঁর বিজয় বৈজয়ন্তী।পরবর্তীকালে সে পথের পথিক হয়েছিলেন বহু কৃতবিদ্য ব্যক্তি। বাংলাদেশের কৃতবিদ্য লোক সাহিত্যিক ড. আশরাফ ছিদ্দিকী দীনেশ চন্দ্র সেনের কর্মে প্রাণিত হয়ে সারা বাংলা জুড়ে লোক শিল্পের নানা উপাদান আজও সংগ্রহ করে লোক সাহিত্যের ভূমি উর্ব্বর করে চলেছেন।
‘ঘরের কথা’ ও ‘যুগসাহিত্য’ গ্রন্থপাঠে আমরা জানতে পারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রবেশ সহজ ও সুগম ছিল না। ঈর্ষাতুর, হীনমন্য বহু ব্যক্তির কুৎস্যা ও বিরোধিতা তাঁকে বারে বারে বিব্রত করে তুলেছিল। তবে তিনি সৌভাগ্য বলে পাশে পেয়েছিলেন গুনধর ও প্রজ্ঞাবান প্রণোদনাকারী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। ফলে পঠন-পাঠন-সাহিত্য রচনা সবই ঘুর্ণাবর্তে দিশাহারা। এমন প্রতিকূল পরিবেশে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের শ্রমনিষ্ঠা, সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যপ্রীতি আমাদের প্রেরণা ও আশ্রয় বলেই মনে করি।
আমি আগেও বলেছি বহুবিধ উপাচারে বাংলা লোক সাহিত্যের ভান্ডার টৈইটুম্বর। এই উপাদান ছড়িয়ে আছে মায়া ছড়ানো, ছায়া ঢাকা পল্লীর আনাচে কানাচে। দেশের জেলায় জেলায় নতুন নতুন লোকসাহিত্যের উপাদান আজও উদ্ধার হচ্ছে। সেই যাত্রার উদগাতা ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছু লোক উপাদান লোক নির্যাস সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং তাতে বেশ চমৎকৃতও হযে সম্ভাবনা আর উপযোগীতার অনুভব করেছিলেন।
মৌমনসিংহ গীতিকার আখ্যানগুলো লোকমুখ থেকে সংগ্রহ করে পূর্ববঙ্গ গীতিকা তিনি উদ্ধান করে কার্য সমাধা করেননি তিনি। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বহু প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। ত্রিপুরা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ থেকে তিনি প্রচুর পুঁথি সংগ্রহ করেন। এই সংগ্রহ কার্যে লিপ্ত হয়ে দীনেশ চন্দ্রকে বহুবার অনিদ্রা অনাহারকে পথের সঙ্গী হিসেবে গ্রহন করে নিয়ে ছিলেন। পুঁথি সংগ্রহের ফলে দীনেশ চন্দ্র ১৫০ এর অধিক মনসা দেবীর ভাসান গানের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেখান হতে ২২ কবির মনসা মঙ্গল পুঁথির চাঁদ সওদাগর, বেহুলা,সওদাগরের, দয়ার, নাচারী, ত্রিপদী ছন্দে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আখ্যান তাঁরই শ্রমসাধ্য ফসল।
পুঁথি সাহিত্য সংগ্রহে আগ্রহীও আত্মনিবেদিত জনদের মধ্যে মুসলিম কবি, লেখকদের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। এই পুঁথি সাহিত্য আমরা মুসলিম করি আলাওলের নাম পাই। আর বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে সংগৃহিত পুঁথি সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কালে এই সকল সাহিত্যের উপর নির্ভর করে বহু সহীত, চলচ্চিত্র, কবিতা, নাটক,পালা রচিত ও পরিবেশিত হয়েছে তার হিসেব করাও কঠিন।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ‘রামায়ণী কথা’, ‘বেহুলা’, ‘জড় ভরত’, ‘ধরা দ্রোন’ ও ‘কশধ্বজ’, ‘সুকথা’ ইত্যাদির মত বহু মূল্যবান লোক সাহিত্যের উপাদান সমৃদ্ধ পুস্তুক আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘বৃহৎ বঙ্গ’ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রচনা। এই গ্রন্থটিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত সময় কালের সমাজও রাষ্ট্রীয় জীবন, লোক শিল্প, লোক সাহিত্যের হরেক রকম উপাচার। লিখিত বিশাল সংগ্রাম-যা প্রতিটি মানব হৃদয়কে অনায়াসেই আকর্ষণ করতে পারে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় বৃহৎবঙ্গ, কাজে কাজে দীনেশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ একে অপরের খুব কাছাকাছি এসে পড়েন। দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিকাশ সাধনাকে যেমন সম্মান দিয়েছিলেন, ঠিক রবীন্দ্রনাথ ও দীনেশ চন্দ্রের প্রতিটি রচনাকে শিল্প ও সাহিত্যের অনুসঙ্গে অপূর্ব সম্পদ বলে স্বীকার করেছেন।
১৯১১ সালে দীনেশ চন্দ্রের লেখা ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ইংরেজিতে প্রকাশিত হলে পাশ্চাত্যের বহু মনীষীর কাছ থেকে তিনি ভুঁয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই পুস্তুকখানি সেই সময় তাঁকে মুকুটহীন সম্রাটের সম্মান এনে দেয়। পাশ্চাত্য সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র সেনাটি, রিচ, ডেভিস, বারনেট, ব্যারন এবং বার্গ প্রমুখ বিখ্যাত ইউরোপীয় পন্ডিতগণের কাছে ব্যাপকভাবে তিনি সমাদৃত হন। তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে’র অনেক খানি স্থান বৈষ্ণব প্রসঙ্গ অধিকার করেছিল। তিনি তো বৈষ্ণব ছিলেন না। তথাপি চৈতন্য এবং তার সঙ্গী মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্য ‘বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়’ প্রভৃতি পুস্তুকে তিনি বৈষ্ণব সম্বন্ধে অনেক কিছু লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর লেখা “সুবল সখার কান্ড” আরও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
বহু শতাব্দী কাল পাশাপাশি বাস করার ফলে লোক সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন জনজমায়েতে এই সাহিত্য শ্রুতিতে সবিস্তার ও সকাতরে পরিবেশিত হয়েছে যুগের পর যুগ। এ সাহিত্য পরিবেশনে ভাষা নিজস্ব ভঙ্গী ও চরিত্রগত ধারা সৃষ্টি করেছিল। এ সমস্ত বঙ্গ বাসীর ভাষা। এ ক্ষেত্রে জাতি ভেদ নেই। ময়মনসিংহ গীতিকায় উর্দু উপাদান ততটা ঢুকেছে, যতটা প্রকৃতপটে উর্দু এ দেশে এসে বাংলার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। দীনেশ চন্দ্র সেনের সাহিত্যে উর্দু কিংবা ভিন্ভাষার অনুপ্রবেশ অতিসাধারণভাবে মানিয়ে গেছে।
ময়মনসিংহ গীতিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ দীনেশ চন্দ্রের মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয়েছিল তা থেকে উভয়ের মধ্যে একে অন্যের প্রতি বিষয়গত শ্রদ্ধা ও সমীহবোধকে আমরা অনুভব করতে পারি। সাহিত্যের বিকাশমান ধারাকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করার আকুল প্রয়াস উভয়কেই মহিমান্বিত করেছে। উভয়ের মধ্যে বহু পত্রালাপ হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত কুশল বিনিময়, সুখ-দু:খের সংবাদের পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ক তাৎপর্য পূর্ণ আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা, অভিমত গুলোই ছিল পত্রের মূল বিষয়। তেমনি একটি পত্র এখানে উপস্থাপন করা হল। দীনেশ চন্দ্রের সাহিত্য কর্মের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথের এই আবেগঘন একটি পত্র পাঠে বিষয় খানা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন কল্যাণীয়েসু,
“বিজয়ার আশীবার্দ গ্রহণ করবেন। বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গল কাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুস্করিণী। কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা বাংলা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত্ব:উচ্ছসিত অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্মবিস্তৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি। এই আবিস্কারের জন্য আপনি ধন্য”
ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এক সময় মৈমনসিংহ গীতিকার ইংরেজী অনুবাদ হয়। বাংলা লোকসাহিত্যের এই অমূল্য সম্ভার হৃদয় হরণ করে ইংরেজী ভাষাবাসী সাহিত্য প্রেমিদের। বাংলার তৎকালীন গভর্ণর লর্ড রোনাল্ডসে-এর মুখবন্ধ সহ মৈমনসিংহ গীতিকা ইংরেজীতে ভাষান্তরে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই আয়োজনটি ছিল বাংলা লোক সাহিত্যের সাথে ইংরেজী লোক নির্যাসের মেলবন্ধন রচনার অনুপম প্রয়াস। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের এক্ষেত্রে অবদান প্রণিধান যোগ্য বিষয়।
দীনেশ চন্দ্রের ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকার কৃতিত্বে রয়েছে তার অমূল্য ভাষা সম্পদ। বাংলার বহু পল্লী গ্রামে ঘুরে ঘুরে তিনি বহু পল্লীগীতি, লোক কাহিনী, লোককথা সংগ্রহ করেছিলেন। পূর্ববঙ্গ গীতিকার শ্রেষ্ঠ পালাগুলির মধ্যে চৌধুরী লড়াই, কমল সওদাগরের পালা, আয়না বিবি, হাতি খেদার গান, ভেলুয়া, কাফন চোর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে চন্দ্র কুমার দে’র সহযোগিতার কথা স্বীকার করতে হবে। মৈমনসিংহ গীতিকার বাহিরেও দীনেশ চন্দ্র সেন আঞ্চলিক ভাষা সংস্কৃতিক বেশ কিছু উপাদান সংগ্রহ করে বাংলা লোক সাহিত্যের ভিত্ মজবুত করে তুলে ছিলেন।
পুঁথি সংগ্রহ, তা পাঠ ও বিশ্লেষণ, গ্রন্থ রচনা ইত্যাদি কাজে কায়িক ও মানসিকভাবে আত্মনিয়োগে অস্বাভাবিক পরিশ্রমের দরুন তিনি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৯৭ সালে চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা ত্যাগ করে কলকাতা চলে যান। মূলত বৃষ্টির ভেতর কাজ করতে গিয়ে এই জটিলতার সৃষ্টি। এ সময় তিনি এত অসুস্থতার মধ্যেও গবেষণা কর্মের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতেন এবং জোর করে কাজ করতে চাইতেন। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর সেরে উঠে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বি.এ পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের পরীক্ষক এবং ১৯০৯ সনে উক্ত বিষয়ের রিডার নিযুক্ত করে। ১৯১০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য মনোনীত হন। ২০ বছর তিনি এই পদে ছিলেন। তিনি তাঁর গবেষণা কর্ম সম্পাদনা করে প্রকাশের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশীপ” লাভ করেছিলেন। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে “ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য” নামে একটি বিভাগ খোলা হলে তিনি উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন। দীর্ঘ বারো বছর অত্যন্ত কৃতিত্বের সহিত বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৩২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আদর্শ শিক্ষকরূপে তিনি যেমন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তেমনি তাঁর সাহিত্য চর্চা ও গবেষণাও বিদগ্ধ মহলে সপ্রশংস ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ নবদ্বীপের বিদগ্ধ জননী সভার মহামহোপাধ্যায়গণ তাঁকে ‘কবি শেখর’ এবং ভারতীয় ধর্ম মহামন্ডল তাঁকে ‘প্রত্মতত্ত্বভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলা লোকসাহিত্যের অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-লিট উপাধি দেয়। ১৯২২ সালে ইংল্যান্ডের রাজা (প্রিন্স অব ওয়েলস) ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন। সেই সময় কয়েক জনকে ডক্টরেক্ট উপাধিকে ভূষিত করেন। দীনেশচন্দ্র তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। ১৯৩৯ সালে ফরাসি সাহিত্যিক রোমাঁ রোঁলার বোন দীনেশচন্দ্রের পুস্তক গুলো থেকে কয়েকটি কবিতা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন এবং দীনেশচন্দ্রের ভূমিকাসহ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। কবিতাগুলো ছিল লোক আঙ্গিকের সংগৃহিত তত্ত্ব ও তথ্যের উপর রচনা করা তাঁর স্বরচিত কবিতা। এখানে উল্লেখ্য যে, দীনেশচন্দ্রের গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন বাংলার ভুতপূর্ব গভর্ণর ও ভারত সচিব লর্ট রোনাল্ডসে। দীনেশচন্দ্র তাঁর কর্মজীবনে বেশ কিছু মানুষের সহযোগিতাও পেয়েছিলেন। ত্রিপুরার রাজার অর্থ সাহায্যে তাঁর, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন ভাবে তিনি সমর্থজনদের নৈকট্যলাভের ভিতর দিয়ে বাংলা লোক সাহিত্যের অনুরাগী হিতৈষনা যেমন লাভ করেছিলেন তেমনি অনেক অভিজাতদের সেই মনষ্ক করে তুলেছিলেন। যদিও অভিজাত ধনাঢ়্য শ্রেণীকোন এক সময় লোক সাহিত্যকে অশিক্ষিত শ্রেণীর বিষয় ভেবে পাশ কাটানোর একটা ব্যাপার ছিল। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে তিনি মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সনের ২০ শে নভেম্বর মানিকগঞ্জের এই মাণিক তাঁর ভারতের কলকাতা শহরের বেহালার রূপেশ্বর ভবনে পরলোকগমন করেন। বনেদী সাহিত্যের চকচকে ইমারতের পাশে ঘেষে সুদৃশ্য লোক সাহিত্যের চৌচালা গোলা ঘর বেধে রেখে গিয়ে ছিলেন।
আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের রচিত গ্রন্থাবলী, লেখা লেখির একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা এখানে সংযুক্ত থাকা সমীচিন মনে হল।
১। কুমার ভুপেন্দ্র সিংহ (কাব্য-১০ এপ্রিল ১৮৯০)
২। জন্মান্তরবাদ-অনুসন্ধান পত্রিকা; ৩০ ফাল্গুন, ১২৯৭
৩। শেক্সপীয়র বড় কি কালিদাস বড়? জন্মভূমি পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ ১২৯৮
৪। বাল্মীকি
৫। হোমার, রামায়ন ও ইলিয়ড-’অনুসন্ধান পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ ও ১৫ আষাঢ় ১২৯৯;
৬। বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-১ম ভাগ (ইংরেজ প্রভাবের পূর্ব পর্যন্ত)-২ ডিসেম্বর, ১৮৯৬।
৭। তিন বন্ধু (উপন্যাস); ৮। রামায়ণী কথা (রবীন্দ্রনাথের ভুমিকাসহ) ১৯০৪,
৯। বেহুলা; ১০। সতী; ১১। ফুডরা (পৌরাণিক কাহিনী) ১৯০৭, ১২। জড় ভারত, ১৯০৮, ১৩। সুকথা-১৯১১২; ১৪। গ্রহশ্র ১৯১৬; ১৫। নীলমাণিক (পল্লীচিত্র) ১৯৯৮; ১৬। সাঁঝের ভোগ (শিশুপাঠ্য গল্প) ১৯২০, ১৭। মুক্তাচুরি (পৌরাণিক আখ্যায়িত) ১৯২০; ১৮। রাগরঙ্গ ( পৌরাণিকা আখ্যায়িতা) ১৯২০; ১৭। গায়ে হলুদ; ১৯২০ ২৩। বৈশাখী (শিশুপাঠ গল্প) ১৯২০; ২৪। সুবল সরকার কান্ড (বৈষ্ণব উপাখ্যান), ২৫। বৈদিক ভারত ১৯২২; ২৬। ভয় ভাঙ্গা (গল্প) ১৯২৩; ২৭। দেব মঙ্গল (গল্প) ১৯২৪; ২৮। আলোকে আঁধারে (উপন্যাস) ১৯২৫; ২৯। কানু পরিবার ও শ্যামলী খোঁজা (পৌরাণিকা আখ্যায়িকা) ১৯২৫; ৩০। চাকুরির বিড়ম্বনা (উপন্যাস) ১৯২৬; ৩১। ওপারের আলো (উপন্যাস) ১৯২৭; ৩২। মহাভারত ১৯১২; ৩৩। বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় ১ম খন্ড ও ২য় খন্ড ১৯২৪; ৩৪। মৈমনসিংহ গীতিকা নামে প্রকাশিত) ৩৫। গোবিন্দ দাসের কড়চা (নব সংস্করণ) সম্পাদক-দীনেশ চন্দ্র সেন ও প্রভুপাদ বনেয়ারী লাল গোস্বামী ১৯২৬, ৩৬। হরিলাল (সম্পাদক-দীনেশচন্দ্রসেন ও খগেন্দ্র মিত্র)।
তথ্যকণিক সম্বলিত পাদটিকা :
দীনেশচন্দ্রের গ্রন্থাদি বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। বিশেষ করে অমর কীর্তি “ ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাড” এসব কিছুর মধ্যে তাঁর অমর কীর্তি মৈমনসিংহ গীতিকার সম্পাদনা (১৯২৩), পূর্ববঙ্গ গীতিকা তিন খন্ড (১৯২৬/১৯৩২) বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদসহ; যা বাংলাদেশ থেকে ১৯৯৫ এ ড: আশরাফ সিদ্দিকী কর্তৃক ২০০০ সালে নতুনভাবে বৃহৎ কলেবরে সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এটি এখন চরম সত্য বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে দীনেশ চন্দ্রের এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। যদিও তাঁর জীবন ছিল নানাভাবে স্বল্পতার বেড়াজালে বেষ্টিত। জীবনের বেশীর ভাগ সময় বহু কঠিন রোগ আক্রান্ত থেকেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের এমন দিক ছিল না, যা তাঁর চোখে পড়েনি, বিচরণ করেননি। বাহিরের দিক থেকে দীনেশ চন্দ্রের বহুমুখী কর্ম ও প্রতিভা, নেতৃত্বে ও গুরুত্ব আমাদের চোখে যতই পড়–ক অন্তরের দিক থেকে তিনি ছিলেন লোকয়ত বাংলার প্রাণের নির্যাস উদ্ধারকারী কোমল হৃদয়ের এক উজ্জ্বল তারকা।
দীনেশচন্দ্র সেন জীবনে অনেক পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। ১৯৩১ সালে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ‘জগত্বারিনী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে। ১৯২৯ সালে তিনি হাওড়ায় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে’র মুল সভাপতি এবং ১৯৩৬ সালে রাঁচিতে অনুষ্ঠিত ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে’র মূল ও সাহিত্য শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
পাদটীকা : আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন সংগৃহিত মৈয়মনসিংহ গীতিকার বছর ব্যাপী শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের সার্বিক আয়োজনে আমার এই নিবেদন তাঁরই স্মৃতির উদ্যোশে উৎসর্গীত হোক।
লেখক: ভাস্কর ডি.কে. দাশ মামুন।
গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
পরিচালক: সন্দীপনা
ফোন: ০১৮১৯৬১৬০৫১