
চাঁদপুর: দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে সাবেক তিনবারের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার বড় ভাই ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু মিলে চাঁদপুরে গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতির রাজত্ব। তাদের রাজত্ব কায়েমে প্রথমেই চলে আসে বালু খেঁকো নামে পরিচিতি পাওয়া সেলিম চেয়ারম্যানের নাম। জনতার রোষানলে পড়ে যার রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে ৫ আগস্ট। কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে চাঁদপুরের স্বাস্থ্যখাতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দালাল চক্রের বিরুদ্ধে নেয়া প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপে গণমাধ্যমের সামনে নতুন করে বেরিয়ে আসে দুর্নীতির আরেক রাজত্ব। ফলে ধারাবাহিক অনুসন্ধানে নতুন করে বেরিয়ে আসে আরো একজন ‘সেলিম’ এর নাম।
অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট লোকদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, সেলিমের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি থেকে কিভাবে হয়ে উঠলেন অফিস সহায়ক।
যেভাবে প্রকাশ্যে আসে সেলিম ॥ চাঁদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি সেলিম হোসেন। যিনি এতদিন অত্যন্ত চতুরতার সাথে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যান। পূর্ব রাজত্বের বিস্তার অব্যাহত রাখতে ভোল পাল্টিয়ে নতুন কর্তার ছায়া খুঁজতে গিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে আসেন। ধরাছোঁয়ার ভাইরে থাকা সেলিম প্রকাশ্যে আশার সূত্রপাত ঘটে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফ্রন্ট যোদ্ধা রাকিব ভূঁইয়ার ওপর চাঁদপুর তাকওয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা হামলা করার পর। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন ঘটনাটি তদন্ত করতে হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রমের বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা দেন। ফলস্বরূপ, বিগত ১৪ নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়। মূলত এখান থেকেই ঘটনা নতুন মোড় নিতে শুরু করে। তাকওয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করার পরই শুরু হয় বর্তমান সিভিল সার্জনকে নিয়ে নতুন নাটক মঞ্চায়নের অপচেষ্টা। এর সূত্র ধরেই চলে এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধান।
যেভাবে দুর্নীতির চক্র তৈরি করে সেলিম ॥ অনুসন্ধানে একে একে বেরিয়ে আসতে শুর করে সেলিম নিয়ন্ত্রিত চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দীর্ঘদিন ধরেই চলমান দুর্নীতির রাজত্ব কায়েমের সাথে জড়িতদের নাম। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, সিন্ডিকেটের প্রধান সেলিম নামের এই চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেলিমের হাতে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে যখন যেই সিভিল সার্জন ছিলেন, তারা তার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন চাঁদপুরে কর্মরত সাবেক একাধিক সিভিল সার্জন ও জেলায় কর্মরত কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে ধরেছেন চাঁদপুরের হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক এবং ভুক্তভোগী মহল।
সেলিমের খবরদারি ॥ অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সেলিমের চাকরি শুরু হয়েছিল অডিও-ভিজ্যুয়াল হেলপার হিসেবে। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দিপু-টিপুর রাজনৈতিক মদদে এবং এ অফিস থেকে উত্তোলনকৃত অর্থ সরবরাহের ফলস্বরূপ অফিস সহকারী পদে কাজ করেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে সেলিম নতুন করে আরেকটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাদের সহযোগিতায় এ পদে বহাল থেকে তার ‘অবৈধ’ ক্ষমতার বলয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পূর্বের ন্যায় নিয়োগ, বদলি এবং বিভিন্ন টেন্ডার ইস্যুতে নতুন করে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। যা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাজের পরিবেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সিভিল সার্জনের পদত্যাগ দাবিতে পূর্ব পরিকল্পিত আন্দোলনের ঘটনা ঘটানোর আগের দিন এ নিয়ে জেলার শীর্ষস্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার সাথে পরামর্শ করে, বিদেশ থেকে আসা ভাইকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করার অযুহাতে অফিস থেকে অগ্রিম ছুটি নেন সেলিম। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়- মূলত ঐ ঘটনায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার কৌশল হিসেবে তিনি ছুটির নাটক সাজিয়ে ছিলেন। তবে বর্তমান সিভিল সার্জনের কঠোরতার ফলে অফিসের অভ্যন্তরে এই সেলিমের নানা দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পেতে শুর করে। ফলে সিভিল সার্জনের অপসারণের হীন উদ্দেশ্যে তাকওয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাদের মদদে ঐ দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদেরকে আন্দোলনে নামিয়ে মুখরোচক নাটক মঞ্চস্থ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হন। যা, চাঁদপুরের সচেতন মহল এবং প্রশাসনের তৎপরতায় একেবারেই ভেস্তে যায়।
চাঁদপুরের ভুক্তভোগী একাধিক হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ও বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সেলিম গত ১৫ বছর ধরেই স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের বদলি এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ আদায় করতেন। এছাড়া, টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে তার অনৈতিক হস্তক্ষেপে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করার বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেলিম তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে বিগত ১৫ বছর যাবত কাজ করছেন। একইভাবে তিনি সব ধরনের নিয়োগ, বদলি এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত করেছেন। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের অভিযোগের পরিমাণ যত বড়ই হোক না কেন, প্রশাসনিক কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায়, ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীকালে নতুন রাজনৈতিক বলয়ে এই সেলিম তার পূর্বের কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছেন।
বিপুল সম্পদের মালিক সেলিম ॥ এদিকে অনুসন্ধানকালে সেলিমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ আসে, তিনি বিপুল পরিমাণে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি হিসেবে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়টি সর্বমহলে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সরেজমিনে চাঁদপুর শহরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে তার বিলাসবহুল একাধিক বাড়ি এবং সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে (উম্মে ভিলা, হোল্ডিং নং-৫৯৯, প্রফেসর পাড়া) এবং নাজির পাড়ায় রয়েছে আরেকটি পাঁচতলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়ি (ফারুক কবিরাজ চেম্বারের পাশে) যার হোল্ডিং নং-৮৫১ (শুধুমাত্র এই বাড়ির জমির মূল্য প্রায় কোটি টাকা)। তবে এসব বাড়ি ও জমি নিজ নামে না করে কৌশলে নিকটাত্মীয়দের নামে করেছেন।
এ ছাড়া একটি প্রাইভেট গাড়ি এবং আজাদ ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্বের অভিযোগ রয়েছে। তার নামের সাথে যুক্ত এসব সম্পদ তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আর তাই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে এত সম্পদ অর্জন কীভাবে সম্ভব। তা নিয়ে জেলাজুড়ে সর্বত্রই জোর সমালোচনা চলছে। এই সেলিম নিজেকে এতটাই প্রভাবশালী করে তুলেছিলেন চাঁদপুরে কর্মরত সাবেক সিভিল সার্জন এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তার অবৈধ কার্যক্রমের সামনে নিতান্তই অসহায় ছিলেন। সেলিম তার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে তার পছন্দের লোক ছাড়া কাউকে পদায়ন করতে দেননি। আর তাই চাঁদপুর স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তার বিরুদ্ধে আজও মুখ খুলতে ভয় পান।
যে কারণে সেলিমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাননি কেউ ॥ এই কার্যালয়ের একাধিক কর্মচারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার পাল্টালেও সেলিমের প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, অনেক কর্মকর্তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এখনো ভয় পাচ্ছেন। বদলি বা চাকরি হারানোর আতঙ্কে তারা সেলিমের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরব হতে পারছেন না। এভাবে পুরো স্বাস্থ্য বিভাগে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান রয়েছে। এছাড়া, সিভিল সার্জন অফিসের পিযুষ এবং হিসাবরক্ষক ইলিয়াসও সেলিমের কার্যক্রমে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেলিমের সহযোগী হিসেবে তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছে। এ নিয়ে চাঁদপুরের স্থানীয় বাসিন্দা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের উচ্চ মহলের কাছে সেলিমের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
তাদের মতে, সেলিমের মতো ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য বিভাগের শৃঙ্খলা ও সুনাম নষ্ট করে হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের জিম্মি করে রেখেছেন। তাই দ্রুত তার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, দুর্নীতির ‘রাজত্ব’ নতুন করে আরও বিস্তার লাভ করবে।
ভুক্তভোগী অনেকে জানিয়েছেন, সেলিমের পেছনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের যে অভিযোগ, তার প্রভাব বাড়তে থাকলে এই ধরনের দুর্নীতি নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি বৃহত্তর সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা এবং স্বাস্থ্য বিভাগে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ বিষয়ে চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিস ও স্বাস্থ্য বিভাগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেয়, তবে এ ধরনের আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে বেরিয়ে আসতে পারে।
(ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে চলমান থাকবে।)
ফম/এমএমএ/