দেশে দেশে ঈদের খাবার

।। এস ডি সুব্রত ।। সারা দুনিয়াব্যাপী মুসলিম ধর্মাবলম্বীগণের মাঝে আনন্দ বারতা আর ত্যাগের সুমহান মহিমা নিয়ে আসে ঈদ । এর মধ্যে একটি ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি ঈদুল আজহা । ঈদ মানে আনন্দ,ঈদ মানে খুশি , ঈদ মানে ত্যাগ । ঈদ মানে নতুন জামা কাপড়। এসব ছাড়াও ঈদে থাকে নানা রকমের খাবার।  ঈদ মানে প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে সময় কাটানো। নতুন পোশাক ও ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি ঈদে অন্যতম আকর্ষণই থাকে নানা স্বাদের মুখরোচক বিভিন্ন খাবার। ত দেশ ভেদে ঈদের  খাবারে ভিন্নতা রয়েছে। আর প্রতিটি দেশে তাদের ঐতিহ্যবাহী  এ খাবারগুলো ওই দেশের ঈদ আয়োজনে যোগ করে নতুন  মাত্রা।এনে দেয় অন্যরকম আনন্দ অনুভূতি।ব
বিভিন্ন দেশে  ভিন্ন স্বাদের নানা রকমের খাবার থাকে ঈদের আনন্দের অনুসঙ্গ হয়ে ।  বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ঈদের দিনে সেমাই পরিবেশন করা। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় হাতে বানানো চালের সেমাইও পরিবেশন করে। শুধু ঘি, চিনি দিয়ে সেমাই রান্না করা যায়। আবার ঘন দুধ ও চিনি দিয়েও অনেকে রান্না করে থাকে। ঘন দুধ দিয়ে রান্না করা সেমাই পাকিস্তান ও ভারতের মুসলিমদের কাছে পরিচিত ‘শীর খুরমা’ নামে। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্নভাবে এই মিষ্টান্ন তৈরি করে মুসলিমরা। প্রচুর বাদাম ও খেজুর দিয়ে অনেকে তৈরি করে এটি। পিস্তাচিও, আখরোট, আমন্ডস, কিশিমিশসহ নানারকম বাদাম ব্যবহার করে অনেকে। আর সাথে ঘন দুধ ও চিনিতো আছেই। মিয়ানমারের মানুষেরা ঈদের দিন তাদের ঐতিহ্যবাহী এক খাবার ‘শাই মাই’ তৈরি করে। বাংলাদেশের সেমাইয়ের মতোই রান্না, তবে তা ভিন্ন উপায়ে। নারকেল, কিসমিস ও কাজু বাদাম ভাজা দিয়ে তারা ‘শাই মাই’ পরিবেশন করে থাকে।
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ঈদ আয়োজনে রাখা হয় নানা ধরনের মুখরোচক মিষ্টি। এর পাশাপাশি থাকে ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘কেটুপাত’। পাম গাছের পাতায় মোড়া এক ধরনের চালের আটার পিঠার মতো এটি। গোশতের বিভিন্ন আইটেমের সাথে কেটুপাত পরিবেশন করা হয়। ব্রিটেনের মুসলিমদের কাছে ঈদের দিনে জনপ্রিয় একটি খাবার হলো বিরিয়ানি। চাল, গোশত ও সবজি দিয়ে তৈরি এই মুখরোচক খাবারটির সাথে থাকে দই ও পুদিনার চাটনি। খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিটেনে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ হলো এখানকার জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত।
পাতলা রুটি বা প্যানকেকের মতো দেখতে খাবারটি সোমালিয়ায় খুবই জনপ্রিয়। গোশত বা সবজির সাথে গরম গরম পরিবেশন করা হয় ঐতিহ্যবাহী এই প্যানকেক। চিনি ও দই দিয়ে আলাদাভাবেও খাওয়া হয় এটি। ঈদে তুরস্কের ঐত্যিবাহী খাবার হচ্ছে  ‘লোকুম’।  বিভিন্ন রঙের মিষ্টির টুকরো এই ‘লোকুম’ মূলত টার্কিশ ডিলাইট। বরফি আকৃতির বিশেষ এই মিষ্টি তুরস্কের সব ঘরেই ঈদের দিন তৈরি করা হয়। চিনি, স্টার্চ আর খেজুর, বাদামের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় এই ডেজার্টটি। এই মিষ্টি তৈরিতে নানারকম রঙও ব্যবহার করা হয়। শুধু ঈদ নয়, তুরস্কের যেকোনোও উৎসব আয়োজনেও এই মিষ্টি থাকে সবার ঘরে ঘরে। মরোক্কোতে ঈদের বিশেষ খাবারের নাম হলো ‘তাজিন’। ঐতিহ্যগতভাবে এটি রান্নাতে ব্যবহার করা হয় মাটির পাত্র, যেটার নাম তাজিন। আর ওই মাটির পাত্রের নামানুসারে রান্নার নামকরণও হয়েছে তাজিন। সাধারণত ভেড়া ও গরুর গোশত দিয়ে তৈরি করা এ খাবারটি। তবে গোশতের সাথে নানারকম সবজি ও মশলার মিশ্রণও থাকে এতে। খাবারটি ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। মরক্কোর বিশেষ এ খাবারটি পুরো আফ্রিকাতেই জনপ্রিয়। আফগানিস্তানে ঈদের দিন সকালে বিশেষভাবে যে খাবারটি রান্না করা হয়, সেটা হলো বোলানি। পাতলা রুটির ভেতরে সবজি, আলু, ডাল বা কুমড়ার পুর দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হয় এই খাবারটি। পরিবেশন করা হয় টক দইয়ের সাথে।
বসনিয়ার এতিহ্যবাহী  ঈদের খাবার হলো তুফাহিজা। এই রেসিপিটি ঈদসহ বিশেষ দিনে বসনিয়ানরা তৈরি করে থাকে। আপেল সেদ্ধ করে তৈরি করা হয় এটি। সেদ্ধ আপেলের মধ্যে আখরোট বাদামে ভরাট করা হয় এবং হুইপড ক্রিম দিয়ে ওপরে সাজানো হয় সুন্দর করে। ঈদ আয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গোশত জাতীয় খাবার বিশেষ করে ’ল্যাম্ব রোস্ট’ ভীষণ জনপ্রিয়। এছাড়া পুরো রমজান মাস জুড়ে ও ঈদের দিন মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে বিশেষ এক ধরনের কুকি বা বিস্কুট খুবই জনপ্রিয়। মাখন দিয়ে তৈরি বিশেষ এই কুকি বা বিস্কুটের মধ্যে খেজুরের পেস্ট বা আখরোট বা পেস্তা বাদামের পুর দিয়ে ওপরে বাদাম ও হাল্কা চিনির গুঁড়া ছড়িয়ে দেয়া হয়। লেবাননে ঈদ উদযাপন মামুল ছাড়া অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। বাটার, খেজুর ও বাদাম দিয়ে তৈরি করা হয় ছোট ছোট কুকিজ। লেবাননের প্রায় প্রতিটি ঘরেই ঈদে মামুল পরিবেশন করা হয়। রাশিয়ার মুসলিম জনগণের ঈদের দিনের  সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার ‘মানতি’। এটি এক ধরনের ডাম্পলিং বা পুলি পিঠা। মাখানো আটার ভেতর ভেড়া বা গরুর গোশতের কিমার পুর দিয়ে তা ভাপে দেয়া হয়। পরিবেশন করা হয় মাখন ও সাওয়ার ক্রিম দিয়ে।রাশিয়ায় অঞ্চল ভেদে মানতির রেসিপি একেক রকম। কিন্তু যদি বলা হয় রাশিয়ায় ঈদের দিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার কী? উত্তর হবে- মানতি। চীনের বেশিরভাগ মুসলিমদের কাছে ঈদের দিনের প্রিয় খাবার হলো সেখানকার ঐতিহ্যবাহী ‘সাঙজা’। ময়দার লেই দিয়ে মোটা করে নুডলস বানিয়ে তা ডুবো তেলে কড়া করে ভাজা হয়। তারপর তা পিরামিডের মতো করে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। লিবিয়ায় ঈদের জনপ্রিয় খাবার হল জেলি জাতীয় এক ধরনের ডেজার্ট  ‘আসিদা’। আপনি যদি কখনো লিবিয়ায় ঈদ উদযাপন করেন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে সুস্বাদু এই জেলি জাতীয় ডেজার্ট পরিবেশন করা হবে। লিবিয়ানরা গমের ময়দা এবং মধু ব্যবহার করে তৈরি করেন আসিদা।
মরক্কো ও উত্তর আফ্রিকার জনপ্রিয় খাবার কুসকুস  মূলত তৈরি হয় সুজি থেকে। মিষ্টি ও ঝাল দুইভাবেই এটি রান্না করা হলেও বাংলাদেশে ঝাল কুসকুস বেশি জনপ্রিয়। চিংড়ি, মুরগি কিংবা গরুর মাংসের সঙ্গে বেগুন, টম্যাটো, পেঁয়াজ, বরবটি, ব্রকোলিসহ নানা ধরনের সবজি যোগ করা হয় এ ডিশে। ফলে ঈদের দিন সকালের চমৎকার নাশতা হতে পারে উত্তর আফ্রিকার প্রিয় এ খাবার। আরববিশ্বের আরেক জনপ্রিয় স্ন্যাকস ফেলাফেল। এটি বড়া বা পাকোড়া ধরনের খাবার, যার মূল উপাদান হচ্ছে ছোলা। ছোলা পানিতে ভিজিয়ে ব্লেন্ড করে ফেলাফেলের কাই তৈরি হয়। এর সঙ্গে মেশানো হয় মসলা, ধনেপাতা ও নানা মৌসুমি শাকসবজি। সিজনিং হিসেবে গোলমরিচের গুঁড়া বা ওরেগানো পাউডার ব্যবহার করা হয়। তিলও ব্যবহার করা হয় এতে। অনেক সময় রুটির ভেতর ফেলাফেল ও সালাদ দিয়ে রোল করে খাওয়া হয়। জর্ডান, লেবানন, ইয়েমেনে ফেলাফেল ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর উৎপত্তি মিসরে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮

ফোকাস মোহনা.কম