দীপু-টিপুর সিন্ডিকেটে জিম্মি ছিলো জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ

চাঁদপুর স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধানি প্রতিবেদন-১

চাঁদপুর: বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের শাসনামলে চাঁদপুরে স্বাস্থ্য খাতে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ব্যাপক দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী থেকে শুরু করে চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সবাই একটি অজানা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিলেন বলে অভিযোগ উঠে এসেছে। এই দুর্নীতির কারণে জেলার প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর গুনগত মানের অভাব দেখা দেয়। যার ফলে সাধারণ জনগণ প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট এবং দীপু-টিপুর সাঙ্গপাঙ্গরা চাঁদপুরের স্বাস্থ্য খাতে একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আসছিলো বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।

অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, জেলার স্বাস্থ্য বিভাগে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এর পেছনে যারা ছিলেন তাদের অন্যতম প্রধান ছিল মো. সেলিম হোসেন। যিনি চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের কথিত অফিস সহায়ক। এ ব্যক্তি দীর্ঘ বছর ধরে সিভিল সার্জন অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, তিনি অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন করেছেন এবং এই দুর্নীতির মূল কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন।

সেলিমের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ, বদলি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান সবই পরিচালিত হতো। এ সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিত এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মালিককে হুমকি দিয়ে ‘ঘুষ’ আদায় করা হত। সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ও রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।

চাঁদপুরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অনুমোদন এবং লাইসেন্স নবায়ন ছিল সম্পূর্ণ এই সেলিমের নিয়ন্ত্রণে। অনুমোদন বা লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাকে মোটা অঙ্কের ‘ঘুষ’ দিতে হতো। অন্যথায় এই সেলিম ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে জরিমানা করার হুমকি দিতেন।

এছাড়া চাঁদপুরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের নিয়োগ এবং বদলির বিষয়েও সেলিমের ব্যাপক প্রভাব ছিল। কোন চিকিৎসক কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন, তা নির্ধারণে সেলিমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনকি তিনি চিকিৎসকদের রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বদলি করে দিতেন, যাতে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। এতে করে চাঁদপুরে আসা অনেক যোগ্য চিকিৎসক ও বিভিন্ন পদের লোকজন অল্প সময়ে এখান থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সেলিম দীর্ঘ বছর ধরে যে পরিমাণ অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করেছেন, তা দিয়ে তিনি চাঁদপুর শহরে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, প্লট এবং বিভিন্ন ব্যবসার মালিক হয়েছেন। তার বাড়ি এবং সম্পত্তির পরিমাণ এতটাই বেশি; একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে তার এত সম্পদ কীভাবে অজির্ত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শহরের প্রফেসর পাড়ায় ‘উম্মে ভিলা’ এবং ‘ফারুক কবিরাজ চেম্বার’ এর পাশে নাজিরপাড়ায় নবনির্মিত তার পাঁচতলা বাড়ি।

সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছেন। তার রাজনৈতিক মদদদাতা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার বড় ভাই জে আর ওয়াদুদ টিপু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম রোমান, উপজেলা চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী বেপারী, পৌর মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েলসহ আরও কয়েকজন নেতা। সেলিম তার কর্মজীবনে একাধিক রাজনৈতিক দলের সমর্থনে কর্মরত ছিলেন বলে অনুসন্ধানে এমন তথ্য মিলেছে।

যেভাবে সিন্ডিকেটের উত্থান: চাঁদপুর জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন, বিগত হাসিনা সরকারের আমলে চাঁদপুরের প্রভাবশালী মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার ভাই জাওয়াদুর রহমান ওয়াদুদ টিপুর নেতৃত্বে উল্লিখিত স্থানীয় ঐসব প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে সিভিল সার্জন অফিসের ভিতরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো নিয়োগ-বদলি, হাসপাতাল অনুমোদন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স প্রদানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে উক্ত অফিসের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মো. সেলিম হোসেন। যিনি স্বাস্থ্য খাতের অতি পরিচিত নাম, তাকে ঘিরে এ দুর্নীতির সূচনা। সেলিম হোসেন মূলত একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। তবে তার প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল; তিনি দীর্ঘদিন ধরে চাঁদপুরের স্বাস্থ্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে একাধিক সূত্র ও ভুক্তভোগী নিশ্চিত করেছেন।

এই সিন্ডিকেটের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিয়োগ, বদলি এবং সেবার ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ (ঘুষ) আদায়। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিস থেকে শুরু করে জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে সেলিমের ইশারা-ইঙ্গিতে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হতো। স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ এবং ওই টাকা সেলিমসহ সিন্ডিকেটের লোকজন ভাগভাটোয়ারা করে নিতেন।

দুর্নীতির বিস্তৃতি এবং প্রভাব: চাঁদপুরে স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়মের কারণে চিকিৎসা সেবার মান ক্রমেই অবনতি হয়েছে। বেশকিছু হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা অভিযোগ করেছেন-সেলিম এবং তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের অনুমোদন ছাড়া তাদের ব্যবসা চালানো প্রায় অসম্ভব ছিল। কিছু হাসপাতাল মালিকের কথায়, “অবৈধভাবে অনুমোদন নিতে হলে সেলিমের কাছে ‘ঘুষ’ দিতে হতো। ঘুষের টাকা পেলেই তিনি সব কাজ সহজে করে দিতেন।”

এছাড়া সেলিম তার প্রভাবশালী অবস্থান ব্যবহার করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ এবং বদলি করতেন। শুধু তাই নয়, বদলি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা নেয়া হত এবং এতে চাঁদপুরের স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা অবৈধভাবে ভাতা পেতেন। যার ফলে স্বাস্থ্য খাতের কর্মীরা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে আগ্রহী ছিলেন না।

সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তদন্ত: এ বিষয়ে চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সেলিম দীর্ঘদিন ধরে নানা অনৈতিক কাজের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ অর্জন করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ; তিনি স্থানীয় হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কর্মকর্তাদের ওপর নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায় করেছেন। তবে, সেলিমের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে বেশকিছু অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় তাকে চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিস থেকে দিনাজপুরে বদলি করা হয়। তবে তিনি নিজ প্রভাব খাটিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে-স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতোমধ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে সেলিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্রে জানায়, “এ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। শিগগিরই এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করা হবে এবং তদন্তের পর দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

সেলিম সিন্ডিকেটের কারণে চাঁদপুরের সাধারণ মানুষও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে অতিরিক্ত খরচে ভোগান্তি, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অবৈধভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় এবং সেবা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেকের। স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা স্বাস্থ্য খাতে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এ ছাড়াও চাঁদপুর স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে গভীর তদন্তের দাবি জানিয়েছন। তাদের মতে, সেলিমের অবৈধ কার্যকলাপের তদন্ত না হলে চাঁদপুরে স্বাস্থ্য খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন জানিয়েছেন, তিনি চাঁদপুরে আসার পর কিছু অভিযোগ শুনেছেন এবং সেগুলোর সত্যতা যাচাই করার জন্য তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে তাকে বদলি করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, সেলিমসহ অন্যান্য যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অধিদপ্তর চাইলে উচ্চস্ততর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন। ওই কমিটি চাঁদপুরের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিস্তারিত তদন্ত করে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
(ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে চলমান থাকবে।)

ফম/এমএমএ/

মুসাদ্দেক আল আকিব | ফোকাস মোহনা.কম