জান্নাতে যেতে কী পরিমাণ আমল দরকার

।। মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ।। মুসলমান হয়ে ইবাদত করে ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলে জান্নাতবাসী হওয়া যাবে। এটি জান্নাতে যাওয়ার সহজ ও সাধারণ সূত্র। তবে যেকোনো আমল ইখলাসের সঙ্গে করা জান্নাত লাভের অপরিহার্য শর্ত।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের শরীর ও অবয়বের দিকে তাকান না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে লক্ষ করেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমার ঈমানকে খাঁটি করো, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৬৪৪৩)

আমল সব সময় জান্নাতে যাওয়ার মানদণ্ড নয়। অন্যের অধিকার হরণ করে অনেক ইবাদত করেও জান্নাতে যাওয়া যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা কি জানো, প্রকৃত নিঃস্ব বা হতদরিদ্র কে? তারা বলেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ওই ব্যক্তি, যার কাছে কোনো অর্থকড়ি এবং কোনো আসবাব নেই। তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত নিঃস্ব ওই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও জাকাত (নেকি) নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি সে এ অবস্থায় আসবে যে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারো সম্পদ (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে, কারো রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর তাকে (অত্যাচারিত) তার নেকি দেওয়া হবে। পরিশেষে যদি তার নেকি অন্যদের দাবি পূরণ করার আগেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের পাপ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮১০)

তবে বিশেষ কিছু কাজ গুরুত্বের সঙ্গে করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে। যেমন-মুখ ও গোপনাঙ্গের হেফাজত করা। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি উভয় ঠোঁটের মধ্যভাগ (জিহ্বা) ও দুই রানের মধ্যভাগ (লজ্জাস্থান) হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব গ্রহণ করি।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৪)

ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ। কবুলকৃত হজের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করে, কোনো অশ্লীল কথা বলে না এবং পাপকাজে লিপ্ত হয় না, সে মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়ার দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে। আর কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।’ (বুখারি, হাদিস: ১৫২১)

যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই খোদাভীরুরা থাকবে ছায়ায় ও প্রস্রবণসমূহে এবং তাদের বাঞ্ছিত ফলমূলের মধ্যে। বলা হবে, তোমরা যা করতে তার বিনিময় তৃপ্তির সঙ্গে পানাহার করো। এভাবেই আমি সত্কর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি।’ (সুরা : মুরসালাত, আয়াত : ৪১-৪৪)

যারা দুনিয়ার জীবনে উদ্ধত হয় না, ফিতনা-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয় না, তারাই জান্নাতে যাবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা পরকালের সেই আবাস, যা আমি (আল্লাহ) নির্ধারণ করি তাদের জন্য, যারা এই পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকিদের জন্য।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৮৩)

কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘পক্ষান্তরে যে তার রবের সামনে (কিয়ামতের দিন) উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (সুরা নাজিআত, আয়াত : ৪০-৪১)

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা ছোট আমলও কখনো জান্নাতে যাওয়ার কারণ হতে পারে। যেমন হাদিসে আছে, কুকুরকে পানি খাওয়ানোর বিনিময়েও মহান আল্লাহ এক ব্যভিচারী নারীকে জান্নাত দেবেন। আসলে কারো কারো জন্য জান্নাতে যাওয়া খুব সহজ হবে। কারো কারো জন্য তা হবে অনেক কঠিন। জান্নাতে যাওয়া কত সহজ—তার উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো-

আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, একবার আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বসেছিলাম। এ সময় তিনি বলেন, এখন তোমাদের সামনে একজন জান্নাতি মানুষের আগমন ঘটবে। কিছুক্ষণ পর এক আনসারি ব্যক্তি উপস্থিত হলেন, যাঁর দাড়ি থেকে অজুর পানি টপকে পড়ছিল। পরের দিনও নবী (সা.) একই কথা বলেন। সেদিনও ওই আনসারি উপস্থিত হলেন, যিনি আগের দিন এসেছিলেন। তৃতীয় দিন নবী (সা.) বলেন, এখন তোমাদের সামনে এক জান্নাতি ব্যক্তি আসবে। কথা শেষে সেই আনসারি উপস্থিত হলেন এবং তাঁর অবস্থাও আগের দুই দিনের মতো ছিল। অর্থাৎ তাঁর দাড়ি দিয়ে পানি টপকাচ্ছিল আর তিনি নিজের জুতাজোড়া বাম হাতে ধরে রেখেছিলেন। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) চলে যাওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) ওই আনসারি সাহাবির পিছু নেন। তিন দিন ওই সাহাবির বাড়িতে অবস্থান নেন।

তিন দিন অতিক্রমের পর আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) তাঁর আমল খুব নগণ্য মনে করেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাঁর আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, যে আমলের কারণে রাসুল (সা.) তাঁকে জান্নাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আমাকে ডেকে বলেন, আমল তা-ই, যা আপনি দেখেছেন। তবে আমি কখনো কোনো মুসলমানকে ধোঁকা দেওয়ার কথা চিন্তা করি না এবং আমি কোনো ব্যক্তির কোনো কল্যাণে হিংসা করি না, যা তাকে আল্লাহ দান করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) এ কথা শুনে বলেন, এটাই সেই গুণ, যা আপনাকে সেই মর্যাদায় (জান্নাতি হওয়া) পৌঁছিয়েছে। আর এ গুণ অর্জন করার সামর্থ্য আমাদের নেই। [মুসনাদ আহমাদ : ২০/১২৪, হাদিস : ১২৬৯৭ (হাদিস সহিহ)]

মহান আল্লাহ আমাদের জান্নাতে যাওয়ার তাওফিক দান করুন।

সৌজন্যে: দৈনিক কালের কন্ঠ।

ফোকাস মোহনা.কম