চাঁদপুর : শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি বলেছেন, লেখকরা বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েও তাদের সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলায় জেলায় যত লেখক-সাহিত্যিক রয়েছেন, তাদের সহিত্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিভাবে জাতীয় পর্যায়ে তাদের পরিচিতি তৈরী করা যায়, মানুষকে কিভাবে তাদের সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত করা যায়, মানুষের মধ্যে যে সাহিত্যবোধ সেটা কিভাবে আমরা জাগ্রত করতে পারি, সাহিত্য পাঠ, সাহিত্যের রস আস্বাদনে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমরা কিভাবে আরো উদ্বুদ্ধ করতে পারি, এরকম অনেকগুলো উদ্দেশ্যে নিয়ে জেলায় জেলায় সাহিত্য মেলা করবার নির্দেশনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। সে উদ্যোগের অংশ আজকের এই সাহিত্য মেলা।
শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, বাংলা একাডেমির সমন্বয়ে ও জেলা প্রশাসন চাঁদপুরের বাস্তবায়নে দুইদিনব্যাপী জেলা সাহিত্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, আজকের এই সাহিত্য মেলায় বিভিন্ন পেশায় যারা নেতৃত্ব দেন তারা উপস্থিত হয়েছেন। বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থী-ভাই বোনেরা। তাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা। যে কোন জায়গায় তাদের উপস্থিতি আমাদেরকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করে। কারণ আমরা যাই করি, আসলি করি আমাদের নতুন প্রজেন্মর জন্য। কারণ এই বাংলাদেশটি কোথায় যাবে, কেমন বাংলাদেশ হবে, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছিলেন, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তার কন্যা আমাদের দেখাচ্ছেন। সে বাংলাদেশ গড়বার মূল কারিগর হলেন নতুন প্রজন্ম। যত জঞ্জাল তৈরী করেছে স্বাধীনতা বিরোধী ও দেশবিরোধী অপশক্তিরা। আমরা যারা এখন বিভিন্ন দায়িত্বে আছি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা কাজ করছি, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সব জঞ্জাল সরিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি মসৃন পথ তৈরী করে দেয়া। তারপরেও প্রত্যেক প্রজন্মকে নিজে নিজে যুদ্ধটা করতেই হয়।
দীপু মনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ যেখানে যাবার কথা ছিল, আমরা কিন্তু এখনো সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী এই ৫২ বছরের মধ্যে প্রায় ২৭-২৮ বছর আমরা নষ্ট সময় পার করেছি। যখন আমরা সামরিক, আধাসামরিক ও স্বৈরশাসনের মধ্যে ছিলাম, আমরা যে বাঙালি, যে বাঙালিত্বের গৌরব নিয়ে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি বিশ^স্থ থেকে আমরা আমাদের নিজের মত করে স্বদেশ ভূমিকে গড়ে তুলবো এবং নিজেদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন গড়ে তুলবো সেই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা যে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীন দেশটি গড়েছিলাম, আমাদের সেই সমস্ত উদ্দেশ্যকে যারা ধুলিস্যাৎ করবার জন্য প্রায় এই তিন দশক কর্মতৎপরতা ও অপতৎপরতা চালিয়েছে। সে কারণে আজকে আমাদের যে জায়গায় থাকবার কথাছিল সেই জায়গায় আমরা নেই। আজকে একটি রাজনৈতিক দল, তারা নিজেদেরকে রাজনৈতিক দলই বলে নিজেদেরকে। কিন্তু যারা অপরাজনীতি করে তাদেরকে আমরা রাজনৈতিক দল বলব কিনা এটাও ভাববার বিষয়।
মন্ত্রী বলেন, সব কিছুরই ব্যাকরণ থাকে, সাহিত্যেও কিন্তু ব্যাকরণ মানতে হয়। রাজনীতিরও একটি ব্যাকরণ আছে। রাজনীতি হচ্ছে দেশ সেবা ও মানুষের সেবার জন্য। সেখানে যাদের জন্ম হচ্ছে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেবার জন্য, তারাত জন্মই অবৈধ। সেই অবৈধ অপশক্তি এবং তারা এই দেশটাকে বার বার পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা যখনই স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করেছি, তারা বলেছে স্বাবলম্বী হওয়া ভাল না, কারণ বিদেশ থেকে সহায়তা পাওয়া যায় না। তারা চেয়েছে আমরা সারা জীবন ভিক্ষুকের জাতি থেকে যাই। বাঙালি যে স্বগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াবে সেটি তারা চায়নি। কারণ তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাই চায়নি। আমাদের স্বাধীনতার গৌরব নিয়ে সামনের আরেকটি গৌরব গড়ে তুলবো সেটি তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য আমাদের সেই অন্ধকার পাকিস্তানি যুগে, সে আমাদেরকে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার মধ্যে নিয়ে যাওয়া। সে অপশক্তি যারা ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এই জোটটি আজকে সারাদেশে একটি অরাজক অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আর তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবের আদর্শের মানুষেরা আজকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তির সমাবেশ করছে। আজকে কেন আমাদের শান্তির সমাবেশ করতে হবে! শান্তিত আমাদের আছেই। এই শান্তির ঘরে হানা দেয় কারা। তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে, কোথাও কোথাও নির্মূলও করতে হবে এবং সেটি যদি আমরা না করতে পারি, সেখানে কিন্তু আমার সাহিত্য চর্চা চলবে না।
দীপু মনি বলেন, অপশক্তি কিন্তু বার বার আমার ভাষা ও সাহিত্যের উপর আঘাত হেনেছে। কারণ সাহিত্যের বাহন ভাষা, সংস্কৃতির বাহন আমাদের ভাষা। আর এই ভাষার উপর যদি আঘাত হানা যায়, তাহলে আমাদের সবচেয়ে বেশী দুর্বল করে দেয়া যায়। এই জন্য বার বার ভাষার উপর আঘাত এসেছে এবং আমরাই সে জাতি, যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। এই দেশেই রবিন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেই পাকিস্তান আমলে, বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন সব সময় হাতে হাত ধরে চলেছে। আমাদের যে স্বাধীকারের আন্দোলন, সেই আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছিলে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কারণে। পরিপূরক হিসেবে আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছি।
শিক্ষামন্ত্রী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি দেশ্যবরেণ্য কথাসাহিত্যিক এমদাদুল হক মিলন, বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সম্মানিত করায় ধন্যবাদ জানান।
জেলা প্রশাসক কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বরেণ্য কথাসহিত্যিক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক এমদাদুল হক মিলন ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান।
চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক কালচারাল অফিসার আয়াজ মাবুদ এর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সাহিত্য মেলার আয়োজন কমিটির সদস্য সচিব ইমতিয়াজ হোসেন।
দেশ্যবরেণ্য কথাসাহিত্যিক এমদাদুল হক মিলন বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতা এমন একটি শক্তি, যে শক্তি উধাও হয়েগেলে রাজ্য নিঃস্ব হয়ে যায়, দুর্নীতি এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সুতরাং মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার প্রতীকটি যেন কোন জাতি যেন কখনো হারিয়ে না ফেলে। ১৯৭১ সালে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করেছি। ১৯৭১ বলতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা ভাবি। প্রকৃত ইতিহাস কিন্তু আমরা আসলে জানিনা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ছিল। আমি মনে করি, সে মানুষের মধ্যে কিছু স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও আলবদর ছাড়া সে সময়কার প্রতিটি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা। কারণ মুক্তিযুদ্ধছিল একটি গণযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সর্বস্তরের মানুষ করেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ফেনিতে একটি ছোট্ট মেয়ের ভূমিকার উদাহরণ টেনে যুদ্ধের অংশগ্রহন সর্বসাধারনের ভূমিকা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, আমরা অনেকেই বলি মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধ কোন গল্প নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের সবচাইতে বড় গৌরবের ঘটনা। ঘটনা এবং গল্পের মধ্যে অনেক ব্যবধান আছে। গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় কোন কল্পনা থাকে না ঘটনা সত্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে করেছিল।
তিনি আরো বলেন, একটা সময় লিখে জীবন ধারণ করতে গিয়ে অনেক লিখতে হয়েছে। একটা সময় আমার মনে হয়েছে একজন লেখক শুধুমাত্র জীবন ধারণ এবং টাকার জন্য লিখবেন না। একজন লেখক লিখবেন রাষ্ট্রের ও সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে, মানুষের প্রতি ভালোবাসার জন্য। সে ভালবাসা থেকে আমি নুরজাহান নামে একজন মেয়েকে নিয়ে ১৮ বছর সময় নিয়ে বই লিখেছি।
তরুন লেখকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি তাদেরকে একটা কথাই বলি, যদি আপনি লিখতে চান, আপনার কোন শিক্ষক নেই। আপনার শিক্ষক শুধুমাত্র বই। ভাল বই ছাড়া আপনার কোন শিক্ষক নেই। ভাল বই পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন বড় বড় লেখকরা কি লিখেছেন। তাদের লেখার ধরণ বুঝতে পারবেন এবং বিশ^ সাহিত্যের ধরণ জানতে পারবেন। আজকে যে ১৭০জন লেখক এই মেলায় অংশগ্রহন করেছন তাদের সকলকে আমি অভিনন্দন জানাই। এই জেলার অনেক বড় বড় লেখক আছেন, যাদের সাথে আমার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক ও স্মৃতি রয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারসহ সকল শহীদদের মাগফেরাত ও শান্তি কামনায় দাঁড়িয়ে একমিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডাঃ জে আর ওয়াদুদ টিপু, চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. জিল্লুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ইয়াছির আরাফাত, চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানজিদা শাহনাজ, সদর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী বেপারী, চাঁদপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র অ্যাড. হেলাল হোসাইন, চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতি এএইচএম আহসান উল্যাহ প্রমূখ।
এর আগে প্রায় দুই শতাধিক লেখকের অংশগ্রহনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গন হতে একটি বর্ণাঢ্য র্যালী বের হয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে এসে শেষ হয়।
ফম/এস.পলাশ/এমএমএ/