আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান।। ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.) কিয়াম করতেন। তাঁর একান্ত মুরিদ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) কিয়ামের কারণে স্বীয়পীর মুহাজিরে মক্কির প্রতি আরজি পেশ করলে মুহাজিরে মক্কি স্বীয় অবস্থার ব্যাপারে তাঁকে এভাবে অবহিত করেন- দুজনের মুরাকাবা অবস্থায় মুহাজিরে মক্কির আধ্যাত্মিক আকর্ষণে রসুল (সা.) তাশরিফ এনে গাঙ্গুহির হাত ধারণকরত মুহাজিরে মক্কিকে বললেন, সে যা বলেছে (অর্থাৎ গাঙ্গুহি) তা-ই সঠিক। এরপর মুহাজিরে মক্কির হাত ধারণ করে গাঙ্গুহিকে বলেন, তুমি তোমার কাজ কর; আর তাকে (মুহাজিরে মক্কিকে) তার অবস্থায় থাকতে দাও। এতে বোঝানো হয়েছে, কিয়াম করা কোনো জরুরি বিষয় নয় এবং সুন্নাতের বিষয়বস্তুও নয়।
তবে যার মুহাজিরে মক্কির মতো মাকাম হাসিল হয়েছে, তাকে কিয়ামে বাধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিয়ামিরা বলেন, নবী নুরের তৈরি, তিনি সব স্থানে বিদ্যমান বিধায় মিলাদের সময় কিয়াম করে সম্মান প্রদর্শন করা জরুরি। যদি তাই হয় তাহলে কেবল মিলাদের সময় কেন, সব সময় কিয়াম করা উচিত। কারণ তাদের আকিদামতে তিনি সব স্থানেই বিদ্যমান এবং সব সময় হাজির-নাজির! এরূপ আকিদা কেবল যুক্তিহীনই নয়; বরং শরীয়তের মূল আকিদারও পরিপন্থী। ইসলামী শরিয়তের ব্যাপারে জ্ঞানের অপ্রতুলতাই হচ্ছে এরূপ ভ্রান্তিকর আকিদার কারণ। এ ক্ষেত্রে তারা আল কোরআনের ‘শাহিদান’ শব্দটি প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন যা তাদের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতারই পরিচায়ক।
মাটির তৈরি মানুষকে মানুষের জন্য নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে বলে শরিয়তে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। তাঁর ব্যক্তিজীবন, বাল্যজীবন, যৌবনকাল, বৃদ্ধকাল, বিয়ে, সন্তান-সন্ততি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পানাহার, নিদ্রা-অনিদ্রা, রোগ-শোক, মৃত্যু-দাফন ইত্যাদি তিনি যে মাটির মানুষ তারই প্রমাণ। মাটির তৈরি মানুষ নবী হয় কী করে? এরূপ খোঁড়া যুক্তির আশ্রয় নিয়েই কাফিররা স্বীকৃতি দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। নুরের তৈরি রসুল পাঠানোর দাবি ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সে দাবি পূরণ হয়নি এবং নুরের তৈরি রসুলের দাবি যুক্তিসংগত নয় বলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ‘আলমিলা ওয়ানিহাল’ কিতাবের লেখক ইবনে হাজম (রহ.) বলেন, আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে যে প্রধান তিনটি সৃষ্টির স্তরবিন্ন্যাস করা হয়েছে তা নিম্নরূপ- ক. জাতি হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হচ্ছে মাটির তৈরি মানব জাতি।
মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আমি আদমসন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি।’ খ. দ্বিতীয় স্তরের জাতি হচ্ছে নুরের তৈরি ফেরেশতা। তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খলিফা নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জনের আরজি পেশ করেছিল। কিন্তু তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়নি। বরং তাদের দ্বারা মাটির তৈরি আদমকে সিজদা করিয়ে মাটির তৈরি মানব জাতিকে নুরের তৈরি ফেরেশতাদের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গ. তৃতীয় স্তরের জাতি হচ্ছে আগুনের তৈরি জিন জাতি।
এ জাতি থেকেই শয়তান সৃষ্টি হয়েছে। যদি বিশ্বনবীকে ‘নুরের তৈরি রসুল’ মেনে নেওয়া হয় তাহলে এ বিশ্বাস কেবল বাস্তবতা-বিরোধী নয়; বরং তা বিশ্বনবী (সা.) কে জাতি হিসেবে প্রথম স্তর থেকে নামিয়ে দ্বিতীয় স্তরে ঠেলে দেওয়া হয়; এটা নবীর শানে চরম অবমাননা ছাড়া কিছু নয়। অথচ তিনি স্বয়ং এই বলে গৌরববোধ করতেন, ‘আমি বনি আদমের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সন্তান।’ এ ছাড়া তিনি নুরের তৈরি রসুল হলে মাটির তৈরি আদমের সন্তান ও তাঁর বংশধর হলেন কী করে?
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।