এস ডি সুব্রত।।“সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”(নারী –কাজী নজরুল ইসলাম) ।
নারী কখনো ভগ্নী , কখনো স্ত্রী আবার কখনো মা । নারী তার সর্বস্ব দিয়ে একটা সংসার আগলে রাখে পরম মমতায় । নারী তার মা বাবার ঘরে ছেড়ে আসে স্বামীর ঘরে ,আপন করে নিজের সংসার হিসেবে ।
তবু প্রায়শই অফিসে , বাসায় নারীকে নিগৃহীত হতে হয়। নারীর সম্মান ও মর্যাদা বাড়াতে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে পালিত হয় এই দিনটি।
১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নামেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। পরে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আন্দোলন আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সাল থেকে একটি দিন নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। পরে ১৯১৪ সাল থেকে বেশকয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
১৯৭৫ সালে ৮ মার্চ কে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে – “নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ ” । নারীদিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান, শ্রদ্ধা ও সংহতি জ্ঞাপন, নারীর আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবদমন প্রতিহত করা এবং নারীর বিরুদ্ধে নানামুখী আক্রমণ, সন্ত্রাস ও নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে এখনও নারীরা পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত। এই অবদমন আর্থিক ক্ষেত্রে যেমন প্রকট, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট। নারী বিষয়ক তথ্য-পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এ সত্য প্রতিভাত হয় যে, নারীরা ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে।
পশ্চিমা কিছু কিছু দেশে সম্পদ, অধিকার, ক্ষমতা ও অংশগ্রহণে নারী ও পুরুষের সমতার বিষয়টি কিছুটা অগ্রসর হলেও উন্নয়নকামী দেশে অসাম্য ভয়াবহ। অনেক দেশেই নারীরা মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ও অংশগ্রহণের সুযোগ তথা ন্যায্য মানবিক অধিকার বঞ্চিত। বাস্তবতা হলো এই যে, নারীর প্রতি কর্মক্ষেত্রে, পাবলিক প্লেসে, গৃহে, বিদ্যাপীঠে নিপীড়ন, নির্যাতন ও নৃশংসতা চলছে। যৌন লালসার শিকার হচ্ছে শিশু ও বালিকারা। নারী শ্রমিকের উপযুক্ত মর্যাদা ও মজুরি দেওয়া হচ্ছেনা। ও অর্থের জন্য চলছে নারী হত্যা। সামগ্রিক অপরাধের পরিসংখ্যানের সিংহভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে নিহত, নির্যাতিত, আহত নারী ও শিশুর মুখচ্ছবি।
মধ্যযুগীয় নৃশংসতা যেমনভাবে নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামে, গঞ্জে, গৃহকোণে, তেমনিভাবে নারীর সম্ভ্রম হানিকর বহু ঘটনা ঘটছে শহরের শিক্ষিত সমাজের অভিজাত এলাকা, অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। নারী উন্নয়নে অনেকটা এগিয়েছে বাংলাদেশ, এটা সত্য। অনেকক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নারীরা অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে। তারপরও নারীমুক্তি, নারী অধিকার, ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের পথে বহুদূর যেতে হবে বাংলাদেশকে। নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ এখনো নিশ্চিত হয়নি । এই জাগরণের পথে সম্মিলিতভাবে সবাইকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবিস্মরণীয় উক্তির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হব, ‘জাগো নারী বহ্নি-শিখা ‘ ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
