জমিরের ঘুড়ি (গল্প)

প্রতিকী ছবি।

ফয়েজ আহমেদ।। এক গ্রামে জমির নামে একজন কৃষক বাস করতেন। মাঠে মাঠে জমি প্রস্তুত, চারা রোপনের ব্যস্ততা, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি সেচ ও পরিচর্যায় দিন কাটে তার। প্রতিটি দিনের স্বপ্ন মৌসুমের শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে অনুকুল আবহাওয়ার প্রত্যাশা। ফাল্গুন মাসের শেষ দিকের সময়গুলো জমিরের কাছে বেশ উপভোগ্য। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহে নিজেকে তখন খুব চিত্তবান মনে হয়। পোকা-মাকড় দমনে ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দেয়া বাঁশের কঞ্চিতে নাম জানা অজানা পাখিদের ভীড় আর কলকাকলিতে মনটা বেশ প্রফুল্ল থাকে। মাঠের দমকা বাতাসে শিশু কিশোররা তখন ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত থাকে। একটা ঘুড়ির খুব শখ জমিরের। গত বছর বৈশাখী মেলা থেকে একটা ঘুড়ি কিনেছিলেন বটে, কিন্তু লাটাই না থাকায় উড়াবার ফুসরত হয় নি। আজ ঘুড়ি উড়াতে তার বেশ ইচ্ছে হচ্ছে।

রাতে ঘুমানোর আগে ঘুড়িটি হাতে নেয় জমির। এত সুন্দর একটা ঘুড়ি এতদিন দেখার সুযোগ পর্যন্ত হয় নি তার। আলমিরা থেকে নেয়া সুতোর বান্ডিল নিয়ে ঘুড়ির সাথে বাঁধলো। সকালে মাঠে যাওয়ার আগে উঠানে থাকা বাঁশ কেটে একটি লাটাই বানালো।

জমির ঘুড়ি ও লাটাই নিয়ে মাঠে গেল। মাঠের পাশে কয়েক হাত সুতো ছেড়ে ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টা করে। নতুন কেনা ঘুড়ির দু’পাশের ভর ঠিক না থাকায় ঠিকমতো উড়তে পারে না সে। জমির লাটাইয়ে সুতো গুটিয়ে কাজে মনোযোগ দেয়। জমিরের অনুপস্থিতে ঘুড়ি আর লাটাই কথা বলতে শুরু করে। লাটাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ঘুড়িকে আকাশে উড়ানোর কথা দেয়। কাজের ফাঁকে জামির আস্তে আস্তে ঘুড়ি উড়ানোয় সময় দেয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এক সময় ঘুড়ি আকাশে উড়তে সক্ষম হয়। রাতে জমির সুতো গুটিয়ে ঘুড়িসহ লাটাইটিকে ঘরের বাইরে একটা বাঁশের সাথে আটকে রাখে। সেখানে সারারাত দুজনে অনেক পরিকল্পনা করে। সারাজীবন লাটাইয়ের সাথে থেকে আকাশে উড়ার প্রত্যয়ে প্রতিদিন ভোর হয় লাটাই ও ঘুড়ির। মাঠে গিয়ে জমির ঘুড়ি উড়িয়ে কাজে মনোযোগ দেয়। লাটাই নিজে থেকে ঘুড়িকে আকাশে উড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। আকাশে উড়তে উড়তে বেশ অভ্যস্ত ঘুড়ির নিচে নেমে আসতে বেশ খারাপ লাগে। উড়ন্ত পাখির সাথে পাল্লা দিতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু লাটাইয়ের সুতোয় টান পড়ায় খুব বেশি এগুতে পারে না। এভাবেই প্রতিদিন উড়তে গিয়ে লাটাইয়ের প্রতি এক ধরণের বিরক্তি ও অনীহার জন্ম নেয়।

কয়েকমাস যেতেতেই ঘুড়ির কাছে বড় অসহ্য মনে হয় লাটাইকে। লাটাইয়ের সুতোয় আটকে থাকায় সে প্রাণখুলে উড়তে পারেনা। তার মাথার উপর দিয়ে যখন সাঁ সাঁ করে কোন আকাশযান চলে যায় তখন নিজেকে বড্ড নিচে মনে হয়। লাটাই না থাকলে সে হয়তো অনেক উপরে চলে যেতে পারতো। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস এলে মনে হয় এই বুঝি সুতো ছিঁড়লো। আর কল্পনায় অথর্ব লাটাইকে বিদায় জানিয়ে ঘুড়ি উড়ে যেতে থাকে অনেক দূরে। আকাশের সীমা পেরিয়ে এক ছায়াপথ ঘুরে আরেক ছায়াপথে চলে যায় সে। তার কল্পনা মাঝে মাঝে আধ্যাত্মিকতাকে ছাড়িয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কল্পনায় ছেদ পড়ে যখন লাটাইয়ের সুতোয় টান খেয়ে সোজা মাটিতে পড়ে। তখনি মাটিতে থেকে আযোগ্য লাটাইকে মনে মনে গালমন্দ করতে থাকে।

ইদানিং রাতে ঘরের বাইরের ওই বাঁশটিতে লাটাইয়ের সাথে একত্রে থাকতে বেশ রূচিতে বাঁধে ঘুড়ির। অহংবোধের কারণে লাটাইয়ের সাথে ঘেঁষতে তীব্র ঘৃণা হয় তার। এক দু হাত অবশিষ্ট সুতোয় ভর করে পতপত উড়তে থাকে সারা রাত। আর বাতাসকে অনুরোধ করে তাকে যেন এই সুতো ছিড়ে আকাশে উড়ার সুযোগ করে দেয়। বাতাস তাকে বুঝায় তুমি সুতোয় বাঁধা বলেই সুন্দরভাবে উড়তে পারছ, সুতো ছিঁড়ে গেলে তুমি আকাশে হারিয়ে যাবে। ঘুড়ি এসব মানতে নারাজ। সে বাতাসকে নানা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বুঝাতে থাকে। এসব শুনে লাটাই চুপি চুপি হাসে। ঘুড়ির খুব রাগ হয় জমিরের প্রতি। জমির কেন তাকে মেলা থেকে এনে এই ক্ষুদ্র লাটাইয়ে বাঁধলো?

দেখতে দেখতে বৈশাখ মাস এলো। মাঠের ফসল তোলার পর জমিরের হাতে প্রচুর সময়। প্রতিদিন বিকেলে নিজেই ঘুড়ি উড়াতে বের হয়। গ্রীষ্মের বিকেলে মেঘমুক্ত আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে বেশ মজা পায় সে। একদিন বিকেলে জমির ঘুড়ি উড়াচ্ছিলো। উত্তর আকাশে জমে থাকা সাদা মেঘগুলো আস্তে আস্তে লাল রঙ ধারণ করতে থাকলো। আকাশের রঙের সাথে মিশে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে ঘুড়িটাকে। জমির ঝড়ের আভাস পেয়ে লাটাইয়ে সুতো গুটানোর চেষ্টা করতে থাকলো। আর এতেই মেজাজ বিগড়ে যায় ঘুড়ির। এমন সময় বাতাস এসে চুপি চুপি ঘুড়ির কানে কানে বললো নিচে নেমে যাও, কালবৈশাখী আসছে। একথা শুনে ঘুড়ি বাতাসের উপর প্রচন্ড রেগে গেল আর সুতোয় টান পড়ায় লাটাইকে গালমন্দ শুরু করলো। এমনি সময় আকাশ জুড়ে ভয়াবহ শব্দে কালবৈশাখী ছুটে এলো।হেঁচকা টানে সুতো ছিঁড়ে দিলো। দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরন আর সেকেলে লাটাই থেকে আলাদা হতে পেরে মাঝ আকাশেই নাচতে থাকে ঘুড়ি। জমির কোনমতে লাটাই নিয়ে বাড়ির দিকে ভোঁ দৌড়। কিছুক্ষণ পরেই বাতাসের সাথে শুরু হলো বৃষ্টি। ঘুড়ি ততক্ষনে নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেল। আকাশে চমকানো বিজলির আলোয় লাটাই হাতে জমিরকে ছুটতে দেখে তার বেশ হাসি পেল। কয়েক মিনিট যেতেই বৃষ্টির সাথে শিলা পড়া শুরু হলো। চমকানো বিজলিতে শিলার রঙ ঘুড়ির মনকে আরও প্রফুল্ল করে তুললো। হটাৎ বড় একটা শিলা এসে ঘুড়ির মাঝ বরাবর কিছু অংশ ছিঁড়ে ফেললো। তীব্র যন্ত্রনায় কেঁপে উঠলো গোটা শরীর। প্রথমবার সে নিচে নামার প্রয়োজন অনুভব করতে লাগলো। আর জোরে জোরে লাটাইকে ডাকতে লাগলো। এমন সময় বাতাস ছুটে এলো। ঘুড়ি বাতাসের কাছে কান্না জড়িত অনুরোধ করলো তাকে নিচে নামিয়ে দিতে। নিজের ভুল বুঝতে পারায় ঘুড়ির প্রতি মায়া হলো বাতাসের। কালবৈশাখীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সে ঘুড়িকে নিচে পৌঁছে দিতে লাগলো। এমন সময় গগন বিদারী হুংকারে বজ্রপাত হলো। বাতাস কোনমতে ঘুড়িকে জমিরের বাড়ির উঠানে নিয়ে এলেও ততক্ষণে সে ভস্ম হয়ে গেছে।

ফম/এমএমএ/

ফোকাস মোহনা.কম