কবি-মোঃ সালাহ্উদ্দিন হাজরা।।
মাশকুর ছোটো কাল থেকেই মেধাবী। সব কিছুকেই নিজের করায়ত্বে রাখতে চায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে জমে থাকা কালো মেঘগুলোকে যদি অন্য দেশের দিকে পাঠিয়ে দেয়া যেতো তাহলে হয়তো অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বন্যা থেকে দেশকে বাঁচানো যেতো। সে ভাবে হয়তো একদিন আবিষ্কার হবে এমন কোনো প্রযুক্তি যখন মেঘকেও মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে। যেমনি করে নদী ও সাগরকে নিয়ন্ত্রণ করছে। হঠাৎ করে মাশকুরের ফোনটি বেজে উঠে। তার বন্ধু হৃদয় ফোন করেছে। ফোনে মাশকুর হৃদয়কে জিজ্ঞেস করে,
“কিরে লিজার কোনো খোঁজখবর আছে?”
হৃদয়ঃ “এই মাত্র বাড়ি থেকে বের হয়ে রিক্সায় করে শহরের দিকে রওনা দিয়েছে।”
মাশকুরঃ “ওকে, এর পরে কোনো তথ্য পেলে আমাকে জানাবি।”
মাশকুর তার শহরের বন্ধু অজয়ের কাছে ফোন করে বলে,
“লিজা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, সো ওর দিকে নজর রাখ ও কি করে এবং সব খবরাখবর আমাকে জানা।”
অজয় কিছুক্ষণ পর মাশকুরকে ফোন করে বলে,
“লিজা প্রথমে শহরে এসে একটি ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে। সেখানে আগে থেকে বসে থাকা একটি ছেলের সাথে গল্পগুজব করে খাবার খায়। এখন ছেলেটির সাথে কেনাকাটা করছে।”
মাশকুরঃ “ওকে ছেলেটির দিকে নজর রাখ। বাড়ি কোথায় ওর পরিচয় কি সব তথ্য জোগাড় কর।”
লিজার সাথে তুহিনের প্রেমের সম্পর্ক চলছে। মাশকুর তুহিন সম্পর্কে সব তথ্য পেয়ে যায়।
মাশকুর লিজাদের প্রতিবেশী রোকেয়া বেগমের ফোন নাম্বার জোগাড় করে। সেই নাম্বারে নিশাতের মাধ্যমে লিজার গোপন প্রেমের তথ্য ফাঁস করে। নিশাত মাশকুরের পরিচিত আপনজন। রোকেয়া বেগম অনেক চেষ্টা করেও নিশাতের পরিচয় জানতে পারেনি। নিশাত একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করেছিল।
রোকেয়া বেগম গল্পের ছলে লিজার মার কাছে লিজার প্রেমের সব তথ্য ফাঁস করে। সাধারণত মহিলারা নিজের মধ্যে কোনো তথ্য গোপন রাখতে পারে না। সে কথা চিন্তা করেই মাশকুর কৌশলে নিশাতকে দিয়ে রোকেয়া বেগমকে বিষয়টি জানায়।
লিজার মা বিলকিস বেগম মেয়েকে বাড়ির বাহিরে একা যেতে নিষেধ করে দেয়। তুহিন লিজাকে না দেখে পাগলপ্রায়। লিজার মোবাইল সারাক্ষণ বন্ধ থাকে। লিজার সাথে তুহিনের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। টেনশন আর হতাশা তুহিনকে ঘিরে ধরে। তুহিন লিজাদের এলাকায় গিয়েও লিজার সাথে দেখা করতে পারে না। লিজার মা বিলকিস বেগম লিজার মোবাইল জব্দ করে। নিরূপায় লিজা তার মায়ের কারণে বাড়িতে আটকা পড়ে। তুহিনকে না দেখার যন্ত্রণা লিজার মনকে বিষিয়ে তোলে। যতই দিন যাচ্ছে ততই লিজার মানুষিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। মেয়ের অদ্ভুত আচরণ দেখে বিলকিস বেগম আরও কঠোর হয়। মেয়ের সাথে বিলকিস বেগমের সব কিছুতেই দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বিলকিস বেগম বাড়ির মূল গেটে সবসময় তালা মেরে রাখে। তুহিন যে কতবার লিজাদের গেটে এসে ফিরে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। বাড়ির বাহিরে রাখা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বিলকিস বেগম লিজাকে তুহিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি কে তার সাথে তার কি সম্পর্ক। রাগে ক্ষোভে লিজা অকপটে তুহিনের সাথে তার প্রেমের কথা স্বীকার করে এবং তুহিনকে বিয়ে করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। মেয়ের এহেন আচরণ সহ্য করতে না পেরে বিলকিস বেগম সজোরে লিজার গালে চড় মারে। মায়ের হাতে চড় খেয়ে লিজা নিজের রুমে গিয়ে অনেকগুলো ঘুমের ট্যাবলেট একত্রে খেয়ে ফেলে। মেয়ের সাড়া শব্দ না পেয়ে বিলকিস বেগম লোক দিয়ে দরজা ভেঙে রুমে ঢুকে দেখে লিজা মুমূর্ষু অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়। দুদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর লিজা সুস্থ হয়। বিলকিস বেগম মেয়েকে আর একা ঘরে ঘুমুতে দেয় না, মেয়ের সাথে একত্রে ঘুমায়। লিজাকে না দেখে তুহিন হতাশায় ডুবে ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। জগত সংসার সব ভুলে মাদকের মধ্যেই সে লিজাকে খুঁজে পায়। লিজার বাপ থাকে আমেরিকায়। বিলকিস বেগম মেয়ের সম্পর্কে তার স্বামী জাহাঙ্গীর সাহেবের কাছে সব খুলে বলে। স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকায় বসবাস করার। জাহাঙ্গীর সাহেব দ্রুতই দেশে এসে তার পরিবারকে আমেরিকায় নিয়ে যায়। তুহিন ধীরে ধীরে মেন্টেললি অ্যাবনরমাল হয়ে পাগল হয়ে যায়। পরিবারের লোকজন তাকে চিকিৎসার জন্য পাগলাগারদে রেখে আসে।
লিজা আমেরিকা গিয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে পাগলের ডাক্তার হয়। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য জাহাঙ্গীর সাহেব তার পরিবার নিয়ে দেশে আসেন। লিজা তুহিনকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। এক সময় লিজা তুহিনের খোঁজ পায় পাবনা পাগলাগারদে। তুহিনের মুখে শুধু একটি কথাই সারাক্ষণ উচ্চারিত হয়,
“লিজা তুমি কোথায় তোমাকে দেখতে চাই।”
তুহিনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে লিজা যখন কথাগুলো শুনলো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই তো আমি আবার ফিরে এসেছি, আমিই তোমার লিজা।”
তুহিন বলতে লাগলো, “কি মজা কি মজা ফিরে এসেছে আবার ফিরে এসেছে।”
জাহাঙ্গীর সাহেবের নিকট তার মেয়ের বিয়ের জন্য অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু লিজা স্রেফ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সে তুহিনকেই বিয়ে করবে। মেয়ের মুখে পাগলকে বিয়ে করার কথা শুনে বিলকিস বেগম এবং জাহাঙ্গীর সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়েন। সুস্থ বিবেকবান মানুষের দ্বারা সম্পাদিত কাজের বৈধতা আছে কিন্তু অসুস্থ পাগলের দ্বারা সম্পাদিত কোনো কাজের বৈধতা নেই। সে কথা জেনেও লিজা তুহিনকেই ভালোবাসে তুহিনকেই সে বিয়ে করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। এ কথা সমাজে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে যায় যে, আমেরিকা থেকে পাশ করা ডাক্তারনি একটা পাগলকে বিয়ে করবে। সবাই অবাক হয়ে যায় এবং ডাক্তারনি লিজার প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ আরো বেড়ে যায়। বিলকিস বেগম আর জাহাঙ্গীর সাহেব মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। দুজনের ভেতরেই অপরাধ বোধ জেগে উঠে। তারা ভাবতে থাকে তাদের বাড়াবাড়ির জন্যেই বোধ হয় দুটি জীবনের আজ এই করুন পরিণতি। মেয়েকে বুঝানোর মত কোনো ভাষা খুঁজে পায় না তারা। মনও তাদেরকে কোনো সায় দেয় না। কেনো জানি তাদের কাছে মনে হতে লাগলো মেয়ে যা করছে তাই সঠিক। একজন প্রেমের টানে পাগল হয়েছে আর অন্যজন পাগলের ডাক্তার হয়ে তার কাছে ফিরে এসেছে। এমন প্রেমের কথা শুনে গোটা সমাজ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যিকারের ভালোবাসা স্থান কাল পাত্র ভেদে কভু শেষ হয় না বরং তা দ্বিগুণ আকার লাভ করে।
পাগলকে ভালবাসতে দোষ নেই, ভালোবাসা যায় আপন করা যায়। ভালোবাসার জন্য যে পাগল হয় তাকে ভালোবাসতে পেরেই লিজা নিজেকে ধন্য মনে করছে। কিছু জীবন পাগলামিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তুহিন হয়তো আর কখনো তার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে ঠিকই সে কাছে পেয়েছে। লিজা হয়তো কখনো তুহিনের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনতে পাবে না। কিন্তু ঠিকই তার কাছে এসেছে। পৃথিবীর সব কিছু মিথ্যে তাদের দুজনের কাছে ভালোবাসাই সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা এডমিন
‘বর্ণমালা সাহিত্য ভুবন (বসাভু)’ গ্ৰুপ
চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর
মোবাইলঃ ০১৭৮৫৯৯১৫৭৪/০১৮৮৪১৭৩০৩০