Veni Vidi Vici. (ল্যাটিন ফ্রেজ) – এলাম, দেখলাম
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হ’তে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপর,
একটি শিশির বিন্দু ‘’’
কবি গুরু যথার্থই বলেছেন।
আসলে ঘর থেকে না বের হলে, বুঝতে পারবেন না, দেখতেও পারবেন না, কতো না সুন্দর আমাদের বাংলাদেশ ! কতোটা নয়নাভিরাম এর প্রাকৃতিক দৃশ্য ! আমাদের অদেখা-অজানা রয়ে গেছে অনেক কিছুই যেমন – Full many a flower is born to blush unseen-Thomas Gray. । তাই সময় সুযোগ আসলে ভ্রমনে যাওয়া উচিৎ সবার । এতে আপনার প্রাণ হবে উৎফুল্ল, মন হবে সতেজ, প্রশস্ত ও সমৃদ্ব হবে জ্ঞান। জন্মাবে দেশের প্রতি আরো অগাধ প্রেম ও ভালোবাসা । সত্যিই যথার্থ বলেছেন “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি (রবি ঠাকুর)’’।
“এমন দেশটি কোথায়ও খুঁজে, পাবে নাকো তুমি…… –’’(কবি ডি এল রায়)।
গত ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রেসক্লাবের বার্ষিক আনন্দ ভ্রমনে গিয়ে এ অভিজ্ঞতা ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার আরো একবার সুবর্ন সুযোগ হয়েছে- যা ভুলবার নয়। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিলো বান্দরবন। মনে মনে ভেবেছিলাম হয়তো অনেক বানর দেখা যাবে ।কিন্তু মজার বিষয়- একসময় বানরের অঞ্চল বান্দরবানে নেই কোন বানর, একটা বানরের সাথেও দেখা মেলেনি ।আছে সুন্দর পর্যটন স্পট- যেখানে আছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সবুজে ঘেরা পাহাড় আর পাহাড় সুন্দর ও সুপ্রশস্ত সড়ক।প্রতি মিনিটে দ্রুত গতিতে চলাচল করছে প্রচুর গাড়ী ও পিকনিকের বাস। নেই কোন রিক্সার ঝামেলা । মেঘলায় ঝুলন্ত সেতু, জিগজাগ পীচঢালা পথ পাড়ি দিয়ে চাঁদগাড়িতে পড়ন্ত বিকেলে গেলে দেখা যায় নীলাচল পাহাড় ও তার আশপাশের মনোরম দৃশ্য । মনে হয় যেনো বিদেশের কোন টুরিষ্ট স্পটে আছি ।
অপরুপ প্রাকৃতিক বার বার দেখে হয়েছি মুগ্ব ও আপ্লুত। নীলগিরি ’র কথা নাই-বা বললাম। তবে এখানে চাঁদগাড়িতে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা ভয়ংকর । এটা আপনাকে হতাশ বা ভীতু করলেও মনোরম দৃশ্য দেখলে আপনার প্রাণ জুড়াবে। ভুলে যাবেন সব কষ্ট ও আতংক ।
সুপ্রশস্ত ও পীচঢালা পথ, নেই কোন জ্যাম । চাঁদগাড়ির দক্ষ ড্রাইভার খুব দ্রুতগতিতে আপনাকে জিগজাগ ও উঁচু নীচু পথে নিয়ে যাবে এসব স্থানে। যেতে যেতে অনেকবার আপনি আতংকিতও হতে পারেন।কারন এটা এক এডভেঞ্চারাস জার্নি । রোমাঞ্চকরও বটে ।
সুন্দর ও পরিপাটী আবাসিক হোটেলে শুক্রবার রাত যাপন করে পরদিন শনিবার সন্ধায় চলে এলাম কক্সবাজারে । রাতে কোন শিয়ালের ডাক (হুয়াক্কাহুয়া) শুনিনি (কুমিল্লার কোট বাড়িতে যেমনটি শোনা যায়) । কক্সবাজারে এসেই কানে ভেসে এলো সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের গজর্ন। এ গর্জন যে অবিরাম চলছেই ! মনে হলো এগর্জন রয়েল বেংগল টাইগারের । বংগবন্ধুর ওইতিহাসিক ৭ই মার্েচর দরাজ গলায় ১৯ মিনিটের মাষ্টারপিচ ভাসনের গর্জন। এ যে অপ্রতিরোধ্য !
রাতেই চলে গেলাম বিশাল সৈকত কলাতলীতে ।পরদিন হিমছরি, ইনানীতে, নতুন স্পট মারমেইডে । মহা আনন্দ পেলাম মনে ও প্রাণে । সমুদ্র দেখেছি, দেখেছি তার অপরুপ সৌন্দর্য বারবার । ইচ্ছে হয় বার বার যাই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পৃথিবীর সবর্বৃহৎ এ সমুদ্র সৈকতকে কেন্দ্র করে এলাকার কোন লোক বেকার থাকছে না।শত সহস্র লোকের রুটি রোজগার হচ্ছে । ছোট-বড়-মাঝ বয়সী সবাই অর্থ উপার্জনের কাজে লেগে আছেন। অর্রথের বিনিময়ে দিচ্ছেন আগন্তুক টুরিষ্টদের এক ধরনের সেবা ।কেহ ডাব বিক্রি করছেন, কেহ ছবি তুলছেন বা তুলতে সাহায্য করছেন, ঘোড়ায় চড়াচ্ছেন, কেহবা ট্রলিগাড়ীতে আপনাকে চড়িয়ে ৩০০/৪০০ টাকার বিনিময়ে ঘুরে ঘুরে বিশাল সমুদ্র সৈকত দেখাচ্ছেন, প্রবাল দেখাচ্ছেন, কাঁকড়া সৈকতও দেখাচ্ছেন । কেহ ঝাল মুড়ি, চটপটি , খিরাই, কেহ পাকা কলা, বাদাম, পানসুপারি সিগারেট, কেহ বড় ছাতার নীচে বেডে বসার জন্য টাকা নিচ্ছেন ও ঘুড্ডী উড়ানোর ব্যবস্থা করছেন, আবার কোন কোন ড্রপ -আউট শিশু-কিশোর ছেলে -মেয়ে প্রচন্ড অভাবের কারনে বোতলের পানি, হাওয়াই মিঠা ও ফুলের মালা বিক্রি করছেন। মজার ব্যাপার হলো, কোন ভিক্ষুক চোখে পড়েনি কোথায়ও । সবচেয়ে বেশী পকেট কাটছেন অটো রিক্সার ড্রাইভাররা ও স্থানীয় টং দোকানীরা। তবে এটা কারো গায়ে লাগে না ।ভ্রমনে খরচতো হবেই । প্রত্যেক ড্রাইভার খুব ধীরে ও সতকর্তার সাথে আপনাকে নিয়ে যাবে বিভিন্ন আকষর্নীয় স্পটে । আপনার ফিরে না আসা পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করে । ওদের ব্যবহার বিনম্র ও মাজির্ত। বান্দরবানেও স্থানীয় যুবক ড্রাইভারদের হাসিমুখ ও মাজির্ত ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করেছে ।
এক খসড়া (র্যানডম) জরীপে দেখা যায় যে, কক্সবাজারে এখানে সেখানে ঘুরাঘুরিতে , শুটকী কেনা ও বামির্জদের দোকানে কাপড়চোপড় কেনা কাটা, খাবারদাবারে, সুন্দর হোটেলে থাকায় প্রতিদিন এ সমুদ্র সৈকতে টুরিষ্টদের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে দৈনিক প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মতো।
কক্সবাজার থেকে চাঁদপুরে ফিরতেছিলাম গত সোমবার সকালে ।বাসে বসে্ও অনেকখন সমুদ্রের গজর্ন শুনলাম । পরে আর শুনলাম না। তবে রেশ থেকে গেছে মনের এলবামে। মনে হয় গর্জন এখনো কানে বাজে । ভেসে আসে গর্জনের শব্দ। মনে পড়লো ব্রিটিশ রোমান্টিক কবি উইলীয়াম ওয়াডর্সওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০) এর বিখ্যাত ছোট্ট কবিতা ।প্রকৃতির মাঝে ছোট বোন ডরথীকে নিয়ে তিনি একটি স্কটীশ পাহাড়ী মেয়ে কে দেখলেন “ সে ফসল কাটছে আর নীরবে সুমধুর কন্ঠে গান গেয়েই চলছেন। তিনি গোপনে গানটি শুনেছিলেন ।এরপর চলে গেলেন নিভৃতে।তাঁর এ অনুভূতিটি তিনি “দ্য সলিটারি রীপার’’ কবিতার শেষ দু চরনে ব্যক্ত করেছেন।কারন গানের রেশ কাটেনি। ‘’দ্য মিউজিক ইন মাই হার্ট আই বোর, লং আফটার ইট ওয়াজ হার্ড নো মোর ‘’’ । রোমান বীর জুলিয়াস সীজারের মতো বলতে ইচ্ছে করে – ভিনি, ভিডি, ভিসি, অর্থাৎ এলাম, দেখলাম,।
বান্দরবান ও কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প ক্রমশ: সমৃদ্ব ও উন্নত হচ্ছে । রাস্তাঘাট, দোকান পাট ও আবাসিক হোটেল/মটেল ও ভবন সবকিছুই ঝকঝকে ও চোখে পড়ার মতো । রাতের দৃশ্যও মনোরম।
কক্সবাজারে সানসেট বে -তে সমাপনী অনুষ্ঠান হলো রোববার রাত ১১ টায় ।
সভাপতিত্ব করলেন নতুন সভাপতি এ এইচ এম আহসানউল্লাহ। এ অনুষ্ঠানে প্রেসক্লাব সম্পাদক আল ইমরান শোভনের সুস্থতার জন্য সবাই দোয়া করলেন। নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে সবাই প্রশংসা করলেন এ সফরের, কোথায়ও নেই কোন ত্রুটি বিচ্যুতি । এ ভ্রমনে সাংবাদিকদের মধ্যে পারস্পরিক/পারিবারিক বন্ডিংটা সুমধুর ও শক্ত হয়েছে । আসলে একা একা ভ্রমনে কোন আনন্দ নেই ।
এ বাষির্ক আনন্দ ভ্রমন সফল করার পেছনে অগ্রণী ভুমিকায় ছিলেন সাংবাদিক শহীদ পাটোয়ারি, বিএম হান্নান, গিয়াসউদ্দীন মিলন, জিএম শাহীন, মাহবুবুর রহমান সুমন প্রমুখ। ( অবশ্য এঁরা সবসময়ই প্রেসক্লাবের যে কোন কাজে অগ্রসৈনিক )।
সানসেট-বে রিজোর্রটের মালিক প্রিয় ইউনুছ উল্লাহর সহযোগিতাও ভুলবার নয়।
কবিতা আবৃত্তি, সংগীত পরিবেশন ও লটারির মাধ্যমে আনন্দমুখর পরিবেশে এটি শেষ হয় গভীররাতে।
পরদিন সোমবার সকালে যাত্রা করে দুপুরে চট্রগ্রাম নগরে পৌঁছে প্রাক্তন প্রিয় ছাত্র চট্টগ্রাম কোতওয়ালী থানার ওসি ও বীর মুক্তিযোদ্বা ও বাবুরহাট হাই স্কুলের অব: শিক্ষক আ হাই স্যারের সুযোগ্য পুত্র পরাগ ও তাঁর সহকর্মীদের বিনম্র আচরন এবং তার অদ্ভূত আতিথেয়তা সবাইকে করেছে মুগ্ধ ।প্রিয় ছাত্রের এমন আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা কখনো ভুলবার নয়।
চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর আসার পথে লক্ষ্য করলাম মহাসড়ক প্রশস্তকরন ও রেলপথ উন্নয়নের বিশাল ও দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞ । দেশে ব্যাপক উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে । এসব দেখে স্বপ্নের দুয়ার খুলে গেলো।
লিখেছেন: অধ্যাপক দেলোয়ার আহমেদ, সিনিয়র মেম্বার, চাঁদপুর প্রেসক্লাব, চাঁদপুর ।