চাঁদপুরে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েই চলছে, জনজীবন অতিষ্ট

চাঁদপুর: মেঘনা পাড়ের জেলা শহর চাঁদপুরে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে । মসজিদের গেটে, মাছ বাজারে, হোটেল, পার্কে, দোকানের সামনে, রেল স্টেশনে, বাস স্টেশনে, রিক্সা বা অটোরিক্সার কাছে, এখানে সেখানে এদের বেশী দেখা মিলে। এরা অনেকেই শহরের কোর্ট স্টেশন বা বড় রেল স্টেশন ও যমুনা রোড এলাকায় ভাড়ায় ঝুপড়িতে বসবাস করেন। যত্রতত্র মলমুত্র ত্যাগ করে পরিবেশ নষ্ট করছেন।

জানতে চাইলে এরা বলে- এরা সবাই নদী ভাংগতি, গৃহহারা, জমিহারা ও স্বামীহারা ও অসহায় লোকজন ইত্যাদি।

চাঁদপুর শহরে প্রায় প্রতিদিন সকালে বাসা বাড়ির দরজা খুললেই এদের দেখা মিলে। রোজার মাসে তো প্রায় সারাদিনই দেখা যায়। বলে, “ স্যার, জাকাত বা ফিতরা দেন।’’ এক র‌্যানডম জরীপে দেখা যায়, প্রায় তিন হাজার ভিক্ষুক রয়েছে এ জেলা শহরেই ।

কথা বলে দেখা গেছে, এরা বেশীরভাগ স্বামী পরিত্যাক্তা,বা স্বামী মারা গেছে বা স্বামী এক বাচ্চার বাবা হওয়ার পর হঠাৎ নিখোঁজ, আবার এরা নদীর ভাংগনে গৃহহীন ।বলে ’’আমাগো বাড়ি নদী নিয়া গেছে ’’।
সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার এদের সংখ্যা বেশী দেখা যায় শহরের সকল জামে মসজিদের গেটে ও পৌর কবরস্থানের গেইটে , মসজিদের দরজায়, সামনে। পুরানবাজার বড় মসজিদ, চৌধুরি মসজিদ, বেগম মসজিদ, নাজিরপাড়া জামে মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড মসজিদ, শহরের রেল স্টেশন প্লাটফরমে, হাট- বাজারে ।

কথা হয় সানু বেগম (৫০) এর সাথে, শহরের পুরানবাজারের ৪ নং ওয়ার্রডের বাসিন্দা ।জানান তার স্বামী নেই । ছেলেটা পংগু । কাজ করতে পারে না। তাই তিনি ভিক্ষা করেন বায়তুল আমিন জামে মসজিদ গেটে। যা পান তাই দিয়ে সংসার চালান। রাণী বেগম (৩৫) বাস করেন শহরের জামতলায় । স্বামী নেই, মারা গেছেন। তিনটি মেয়ে ছোট ছোট। তাই সংসার চালাতে নিয়মিত ভিক্ষা করেন একই মসজিদের গেইটে । এখানে দুপুরে, বিকালে ও সন্ধায়ও নারী ও পুরুষ অনেক ভিক্ষুক দেখা যায় নিয়মিত। চামেলী বেগম (৪৫) থাকেন শহরের বকুল তলা রোডে । তার কাহিনীও একই ।

সেই ভোলা থেকে আগত নদীতে বাড়িঘর বিলীন হওয়া বৃদ্ব আমির আলী (৭৮)জানান, তিনি কোন উপায় না পেয়ে চাঁদপুর শহরে লঞ্চে এসেছেন তার স্ত্রীকে নিয়ে । থাকেন রেলওয়ের পরিত্যাক্ত ঝুপরিতে ।ভাড়ায় থাকেন। ভিক্ষা করে দৈনিক ২/৩ শত টাকা দিয়ে কোন রকম জীবিকা করেন।

অন্য এক নদীতে -গৃহহারা -ছিন্নমুল বৃদ্বা মহিলা রাশেদা বেগম(৪০), বাড়ি মতলবের উত্তরের জহিরাবাদে । একই কথা জানান তিনিও ।তিনিও থাকেন ঝুপড়িতে, ভাড়ায় ।মাসে ৬০০/০০ ভাড়া দেন। তিনি বলেন ২০ বছর যাবত ভাড়ায় থাকেন শহরের যমুনা রোডে মেঘনা নদীর পাড়ে। তিনি আরো বলেন, তার স্বামী নেই, স্বামীর বাড়ি নদীতে নিয়ে গেছে বহু বছর আগে । তিনি বলেন, “অহন আমাগো নদীতে চলে যাওয়া বাড়ির উপরে দিয়া ঢাকা ও চাঁদপুরের লঞ্চ চলে।’’

অন্য একজন বৃদ্ব মহিলা কুলসুম (৫৬) বাড়ি সদরের সফরমালী গ্রামে গ্রামে। স্বামী অন্ধ , অসুস্থ হয়ে বিছানায় , সন্তান্ও নেই । নেই ঘরবাড়ি ও জায়গাজমি। দিনভর শহরে ভিক্ষা করেন্, ।দৈনিক গড়ে পান ২০০/০০ ২৫০/০০ বা ৩০০/০০ টাকা। সন্ধার লগ্নে বাড়ি ফিরে যান। এভাবেই চলে জীবন ।

অন্য এক বৃদ্ব-অন্ধ লোক ১৫/১৬ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চাঁদপুর শহরে আসেন । তিনিও ভোলা থেকে এসেছেন। তিনি পুরাই অন্ধ । নাম সুভাষ (৬০)।কিন্তু তিনি ব্যতিক্রম বা আত্মসম্মানী । পথে প্রান্তরে বাঁশের বাঁশি বাজান। তার বাঁশিতে বাংলা ও হিন্দি রোমান্টিক গান বাজিয়ে জীবিকা করেন রেল স্টেশন প্লাটফরমে। জীবিকার জন্য কখনো কখনো বিভিন্ন মাকের্টের সামনে, রেল গাড়ীতেও বাঁশি বাজান । তিনি তার সাথে চলার জন্য নিজের একটি ফুটফুটে কিশোরি মেয়েকে সংগে রাখেন।

শুক্রবার জুম্মার নামায়ের আগে ও পরে চাঁদপুর গোর এ গরীবা বাসস্টেশন জামে মসজিদে কমপক্ষে ২শ নারী ও পুরুষ ভিক্ষুককে ভিক্ষার জন্য ছুটাছুটি করতে দেখা যায়। এরা বিভিন্ন বয়সের। ছোট ছোট টিন এজ ও আন্ডার টিন এজের ছেলে – মেয়েরাও এখানে ভিক্ষা করার জন্য ছুটে আসে ।গোরস্থানের গেটের সামনে লাইন ধরে বসে সাহায্যের জন্য ।

রমজানে, শুক্রবার বা অন্য কোন ধর্মীয় উৎসবের দিন (ইদের দিন ) হাজিগঞ্জ বড় মসজিদেও কয়েকশত ভিক্ষুক দেখা যায় গেইটে গেইটে। এখানে সপ্তাহের অন্যদিনও দেখা যায় অসংখ্য ভিক্ষুক ।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায়, ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ভিক্ষাবৃত্তি রোধে বিকল্প কর্সংস্থান প্রকল্পের আওতায় ১০জন অসহায় নারী ও পুরুষ লোকদেরকে যাচাই বাছাই করে পুনর্বাসন করেছিলেন দোকান ও ব্যবসার মালামাল কিনে দিয়ে ।যাতে তারা সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে বসবাস করতে পারেন।

ওদিকে সম্প্রতি হাজিগঞ্জেও ভিক্ষুক পুনর্বাসনের লক্ষে উপজেলা প্রশাসন সমাজ সেবা বিভাগের সহযোগিতায় ১০ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে ।
গত বৃহস্পতিবারও সদর উপজেলা সমাজ সেবা অফিস ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে (৪ জন নারীসহ )১৫ জন ভিক্ষুককেও পুনর্বাসন করার জন্য ১১ জোড়া ছাগল ও ৪ ভিক্ষুককে ৪টি ভ্যানগাড়ী কিনে দেয়া হয় যাতে তারা সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে।

এরপর ফরিদগঞ্জ, মতলব দক্ষিন ও মতলব উত্তরে ৪০ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে ।

শহর সমাজকল্যান বিভাগের অফিসার মোহাম্মদ কামরুজজামান ইউএনবি কে জানান, চাঁদপুর শহরে ভিক্ষুক রয়েছে ৭৯ জন । সদর উপজেলায় ১৭৩ জন।
সরকারের সমাজ কল্যাণ বিভাগ জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় ২০১৯ সালে জরীপ করে ভিক্ষুকদের কর্সংস্থানের মাধ্যমে ধাপে ধাপে তাদেরকে পুণর্বাসন করার উদ্যোগ গ্রহন করছে । সেই ধারাবাহিকতায় সদর, হাজিগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জে ও মতলব সহ জেলার আট উপজেলায় ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে ।

এক র‌্যানডম জরীপের বরাত দিয়ে জেলা সমাজসেবা অফিসের উপ পরিচালক রজত শুভ্র সরকার ইউএনবি কে জানান, জেলায় প্রায় ১২শত ভিক্ষুক রয়েছে । অনেকে চাঁদপুর শহরে আসেন বাইরের জেলা থেকে ।এরা ভাসমান ও মৌসুমী ফকির।কোন ধর্মীয় উৎসবের আগে আসে।এর কিছুদিন পর আবার অন্যত্র চলে যায় ।

প্রসংগত, গত ছয় বছর আগে ”’ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প ’’ চালু করেন চাঁদপুরের প্রাক্তন জেলা প্রশাসক মো সবুর মন্ডল । জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি ”’ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের ’’ আওতায় ১কোটি ১৫ লাখ টাকার তহবিল গঠন করেছিলেন। কিছু ‍পুনর্বাসনের কাজও করেছেন। এরপর তিনি বদলী হয়ে যান। তারপর ডিসি মাজেদুর রহমান খান ও অঞ্জনা খান মজলিশ ও এসেছেন , বদলীও হয়ে গেছেন চাঁদপুর থেকে ।কিন্তু এ প্রকল্পের আর তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি বলে বিভিন্ন সুত্র বলছে।

ফম/এমএমএ/

দেলোয়ার আহমেদ | ফোকাস মোহনা.কম