
সাবেক ত্রিপুরা-কুমিল্লা ও বর্তমান চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার সর্ব পূর্বোত্তর কোনায় অবস্থিত ঐতিহাসিক গ্রাম কাচিয়ারা। ইংরেজ আমলে সিএস জরিপে ৯২নং কাচিয়ারা মৌজা এ গ্রামের নামেই রাখা হয়েছে। কথিত আছে, প্রায় ৪৫০ বছর পূর্বে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ‘কাঞ্চন রাজা’ নামে এক শাসক এই এলাকায় শাসন করতেন। তাঁর বসত বাড়ি এই গ্রামেই ছিল। পরিখা ও পাকা কিছু নির্দশন এখানে এখনো বিদ্যমান আছে। কাচিয়ারা গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে মারুকা নদী নামে একটি নদী আবহমান কাল ধরে নায়েরগাঁও থেকে কচুয়ার সাচার পর্যন্ত প্রবাহিত। ভ্রমন ও ব্যবসার কাজে উক্ত মারুকা নদীটি আজও ঐতিহ্য বহন করে আছে। কাঞ্চন রাজার একমাত্র কন্যা সন্তান ‘কাঞ্চন মালা’। তার নামে রাজা একটি প্রকান্ড দীঘি (১২.৪৩ একর) খনন করেন। যা খননে মঘ জাতির আতিকায় মানুষ ব্যবহৃত হয়েছে যারা এত বড় দীঘি খননে একমাত্র সক্ষম ছিল। কথিত আছে এ দীঘিতে পানি উঠাতে রাজার একমাত্র কন্যাকে বলি দিতে হয়েছে। তাই এ দীঘিটি ‘কাঞ্চন রাজা’র দীঘি বা ‘কাঞ্চন মালা’র দীঘি নামে পরিচিত।
দীঘির দুই পাড়ে যথা পশ্চিম ও উত্তর পাড় চেপ্টা ইট ও চুন সর্কীর দুটি ঘাটলার নিদর্শন আজও রয়েছে। কচিয়ারা গ্রামের ইতিহাস মূলতঃ এ দীঘিটিকে ঘিরেই হয় আসছে।
মুরব্বীদের কাছ থেকে শুনেছি বড় ধরণের খানা, যেয়াফত করতে দীঘির পানিঘেষা জায়গাটি কাচা দুধ দিয়ে ধুয়ে মুছে প্রয়োজনীয় থালা বাসন ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি চাইলে প্রয়োজনের সময় সেগুলো পাওয়া যেত। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দুধ কলা দিয়ে এ দীঘিতে পুজো দিত। স্নান করলেও নাকি পূণ্য ও রোগ মুক্তি হতো এ ছিল তাদের বিশ্বাস। এহেন ইতিহাস এ দীঘি ও এ গ্রামের সঙ্গে জড়িত। ছোট খাটো কিছু নিদর্শন আজও বিদ্যামান।

কাচিয়ারা গ্রামখানি খুব বড় নয়। দীঘিটির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে লোক বসতি আগে থেকেই আছে। উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে কোন বসতি ছিল না। চারপাড় মিলিয়ে দীঘির পরিমান প্রায় ২০ একর। বর্তমানে দক্ষিণ পাড়ে জনবসতি আর উত্তর পাড়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে পিতাম্বর্দী মিয়াজী পরিবারের গড়া কাচিয়ারা দীঘির পাড় জামে মসজিদ ও শাহী ঈদগাহ অবস্থিত। এখানে ১৯৪৫ সালে এলাকার মুরব্বীগণ একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও পরবর্তীতে একটি হেফজখানা গড়ে তোলেন।
বর্তমানে উক্ত মাদ্রাসাটি আলিম শ্রেণি পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে চলছে। এখানে একটি গণ কবরস্থান, একটি ইসলামী পাঠাগার, একটি ইয়াতিমখানা, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কাচিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়টি বিদ্যমান। যা বর্তমানে কলেজে উন্নীত হয়েছে।
কাচিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৬৬ সালে স্থাপিত হয়। সে বছর ঈদুল ফিতরের নামাজের পর এলাকার মুরুব্বীদের শিক্ষাগুরু মতলব উত্তর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর নিবাসী জনাব মো. নুর হোসেন শেখ সাহেবের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত হয়। তখন মাত্র ১৮ টাকা ৫ আনা তহবিল সংগ্রহ করে বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করা হয়। অদ্যাবধি উক্ত প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে চলে আসছে। এ প্রতিষ্ঠানের ভূমি দাতা খিদিরপুর নিবাসী দানবীর মরহুম আলহাজ¦ মৌঃ সেকান্দর আলী পাটওয়ারী। যার জন্ম এ এলাকায় না হলে কাঞ্চন রাজার দীঘির উত্তর পাড়ও হয়তো জনবসতিতে পরিণত হতো।
অবশ্য অত্র এলাকার বহুলোক তাঁর সঙ্গে এ মহতি কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। তাদের মধ্যে ষোলদানা নিবাসী জনাব সৈয়দ আহমদ সাহেব অতুলনীয় সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। সহযোগিতকারীগণ ও অন্যান্য সকলেই উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছেন এবং অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিন্তু এত দিনের তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে।
উল্লেখ্য, ৩০ হাত লম্বা একটি দো-চালা টিনের ঘর থেকে অদ্য ৩৫ শতাংশ ভূমির উপর অট্টালিকা সমূহ দন্ডায়মান। বর্তমানে বিদ্যালয়টি নিজস্ব ভূমির পরিমাণ চার একর ৪৫ শতাংশ।

বিদ্যালয়টির প্রারম্ভিক সময়ে দুর্যোগ অবস্থায় খিদিরপুর মোল্লাবাড়ীতে মরহুম আবুল হাসিম মোল্লা সাহেবের বাংলা ঘরেও মাঝেমধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস করতে হয়েছে। এভাবে চলাবস্থায় ১৯৭০ সালে অষ্টম শ্রেণির ১ম স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়ে ১৯৭১ সালে নবম শ্রেণি খোলার অনুমতি পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে দশম শ্রেণি খোলা হয় ও ১৯৭৩ সালে অত্র বিদ্যালয় হতে প্রথম এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া শুরু হয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চাঁদপুরের কৃতি সন্তান সাবেক দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কাচিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন ভবন ও পুরাতন ভবনের উর্ধমুখী সম্প্রসারণ কাজ সমাপ্তি শেষে উদ্বোধন করেন। তখন এলাকার একমাত্র দাবী হিসেবে একটি কলেজ চাওয়ায় মন্ত্রী মহোদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তাঁরই ঐকান্তিক সহযোগিতায় একাদশ শ্রেণির ভর্তির অনুমোদন পেয়ে স্কুলটিতে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। নামকরণ করা হয় হয়েছে ‘কাচিয়ারা স্কুল এন্ড কলেজ’ আর পূরণ হয়েছে এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন।
লেখক: আব্দুর রাজ্জাক পাটওয়ারী
সাবেক প্রধান শিক্ষক, কাচিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়
মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর।