
—যুবক অনার্য
‘বই পড়া’ – নিয়ে দু’চার কথা বলা খুব জরুরি মনে করি।আমরা বই পড়ি সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক কারণে- রুটি রুজি’র তাগিদে। বলা বাহুল্য এসব বই মূলত পাঠ্যপুস্তক।পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও আমরা বই পড়ি।তো এসব বইয়ের পাঠককে আমরা মোটা দাগে জনপ্রিয় ধারার পাঠক ও সিরিয়াস বা ক্লাসিক ধারার পাঠক হিসেবে ক্লাসিফাই করে থাকি- যদিও এরকম ক্লাসিফিকেশন কতোটা জরুরি, তা আমার বোধগম্য নয়।তবে ক্লাসিফিকেশনের এহেন বাস্তবতা কিন্তু অনেকটাই অনস্বীকার্য।
জনপ্রিয় ধারা কী বা কোন লেখাকে জনপ্রিয়ধারার লেখা বলে এবং কোনটি ক্লাসিক লেখা বা ধারা-বোধ করি এটা একটি ভিন্ন ডিস্কোর্স। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে স্বতন্ত্র প্রবন্ধে আলোকপাত করবার ইচ্ছে রইলো। আজকের আলোচনা একটি বিশেষ বই নিয়ে, এজন্য যে,বইটি কলোনিয়াল ও পোস্ট কলোনিয়াল সময়কালে আমাদের এ অঞ্চলের অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারত তথা বৃটিশ ভারতের আধুনিকতাবাদের বহুমাত্রিক জীবন- সংঘটনে ধর্ম সংস্কৃতি নারীবাদ ইসলামচর্চা ও আন্দোলন রাজনীতি শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস ইত্যাদি ঐতিহাসিক ও ক্রনোলোজিকাল বিবর্তনের ডিস্কোর্স নিয়ে ব্যতিক্রমী বিশ্লেষণ করেছে যা প্রশকংসার দাবি রাখে বৈ কি।
আলোচ্য গ্রন্থের নাম ‘আমাদের আধুনিকতার কয়েকটি দিক’।সম্পাদনা করেছেন বিশিষ্ট লেখক ও ইতিহাস বিশ্লেষক পরিমল ঘোষ।এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে ৬ টি দুর্লভ প্রবন্ধ।লিখেছেন- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, শমিতা সেন, রঞ্জিত সেন, পরিমল ঘোষ ( ২ টি প্রবন্ধ) ও বেঞ্জামিন জ্যাকেরিয়া।
‘ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং আধুনিকতা’ প্রবন্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের আধুনিকতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখর বাবু ইংরেজীকরণের নীতি,ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন, হিন্দু পুনরুত্থানবাদ ও মুসলিম সামাজিক আন্দোলন এবং আধুনিকতা ও তার অন্ত র্নিহিত দ্বন্দ্ব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন।তিনি তার নিজিস্ব চিন্তন ও অভিসন্দর্ভ- এর উপসংহারে লিখেছেন-” পশ্চিমী আধুনিকতাকে আমরা কখনোই পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করিনি,আর সমাজের সর্বস্তরেও তার প্রভাব সমানভাবে পড়েনি।তাই আধুনিক ও প্রাক্- আধুনিক চিন্তাধারা আচার- আচরণ ও প্রথাগুলি মিলেমিশে রইলো।আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে একে আমরা ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সীমাবদ্ধতাও বলতে পারি,আবার একে বিশেষ এক ধরনের মিশ্র আধুনিকতা বা ‘ hybrid modernity’ও বলতে পারি।এর ফলে সমাজে যেমন কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলো,তেমনি আবার কিছু বিষময় ফলও প্রকট হয়ে উঠলো, সামপ্রদায়িকতা যার মধ্যে একটি।”
১৮১৭ সালে জেমস মিল তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ বইতে লিখেছিলেন যে কোন সমাজের সভ্যতার মান নির্ভর করে সেই সমাজে নারীর অবস্থানের উপর।মিলের এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আধুনিকতা ও আধুনিক ইতিহাসেরব পাঠের মধ্যে নারী ঢুকে পড়লো, ও নারী, আধুনিকতা ও জাতীয়তাকে একটি একক প্রতর্কের মধ্যে একই সূত্রে গেঁথে ফেলা গেল। আমাদের দেশে নারী একটি বিষয় হিসেবে এই নির্মাণের মধ্য থেকে উঠে এলো ও জাতীয়তাবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে ক্রিয়া- বিক্রিয়ায় নারীকে ঘিরে প্রশ্ন আধুনিকতা ও শাসনের বৈধতা নির্ণয়ে একটি বিচারের উপায় হিসেবে দেখা গেল।
“আধুনিক ভারতে নারী: পরিবর্তনশীল অবস্থা ও মনোভাব” প্রবন্ধে শমিতা সেন সমাজ সংস্কারে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীর ভূমিকা নিয়ে বৃটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলমান নারীদের পৃথক পথ চলা ও পৃথক মতের অভিযোজনাকে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন….” বস্তুত আমাদের দেশে বিভিন্ন পরম্পরাগত অভ্যাস ছিলো যেখানে নারীর উপর বীভৎস অত্যাচার চলে আসছিল।এইসব অভ্যাসের মধ্যে ছিলো সতীদাহ -যেখানে বিধবা স্ত্রীকে মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত দাহ করা হতো,শিশুকন্যাকে হত্যা করা- উত্তর- পশ্চিম ও পশ্চিম ভারতে যা প্রায়ই ঘটত,বিধবাদের কঠোর অনুশাসন মানতে বাধ্য করা ও তাকে গৌরবজনক মনে করা,ও একই সংগে বিশেষ করে উত্তর ভারতে,মেয়েদের বাল্যবিবাহকে সামাজিক স্কম্মানের সূচক হিসদবে দেখা।ঔপনিবেশিক আধিকারিকরা ও ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারকেরা এইসব অভ্যাসকে প্রমাণ হিসাবে দেখাতে পারলো যে ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান কত নিচুতে ও ভারতীয় পুরুষ কত ভয়ঙ্কর। “
রঞ্জিত সেন “আধুনিক ভারতবর্ষে ইসলামের আত্মজাগরণ আন্দোলন ও ইসলাম চর্চা ” শিরোনামের প্রবন্ধটি এতো ব্যপক কলেবরে লিখেছেন যে এটি একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধের বই হলেও হতে পারতো অবলীলাক্রমে।তিনি বৃহত কলেবরের এ প্রবন্ধ ৩৫ পর্বে সাজিয়েছেন। উনিশ শতকে ভারতবর্ষে ইসলাম চর্চা থেকে শুরু করে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি পর্যন্ত আলোচনা দীর্ঘায়িত করে ওহাবি আন্দোলন শুদ্ধি আন্দোলনের অন্তর্বিরোধ সাম্প্রদায়িকতার আবির্ভাব দ্বিজাতিতত্ত্ব গো-সংরক্ষণ ও গো-হত্যা মুসলিম লীগের জন্ম জিন্নাহ-সমাচার ইত্যাদি ব্যপকভাবে আলোচনা করেছেন এবং যবনিকায় দেখিয়েছেন কীভাবে ভারতবর্ষের সঙ্গে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা প্রতিষ্ঠিত হলো।
সম্পাদক পরিমল ঘোষ লিখেছেন দুইটি প্রবন্ধ -ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক। ভারতীয় “শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস”- এ তিনি শ্রমিকের লড়াইয়ের আদিপর্ব থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠন এবং হালনাগাদ শ্রমিক শ্রেণির প্রতি প্রাদেশিক সরকারের ভূমিকা নিয়ে অথেনটিক আলোচনার সুত্রপাত করেছেন “গান্ধির রাজনৈতিক দর্শন”-এ গান্ধিজির রাজনৈতিক ভুমিকা স্পষ্ট করে দিয়ে লিখেছেন-“আমাদের আলোচনা থেকে ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ যে গান্ধী রাজনীতিতে আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যেকার ফারাককে দূর করতে চেয়েছিলেন।এর উপায় হিসেবে তিনি দেখেছিলেন সত্যাগ্রহকে।সত্য ও স্বাধীনতার জন্য যে কোনো বিবেকবান মানুষ অত্যাচারের বিরোধিতা করতে পারে।গান্ধী বিশ্বাস করতেন একই সংগে সেই বিরোধিতার বৈধ হবার প্রয়োজন আছে,কারণ কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়লে সমাজের উপর আক্রমন হিসেবে তাকে দেখানো যেতে পারে। গান্ধী মনে করেছিলেন সত্যাগ্রহ সেই বৈধ উপায়।
ব্যাঞ্জমিন জ্যাকেরিয়া “জহরলাল নেহেরু ও তাঁর ভারত- রাষ্ট্র” প্রবন্ধে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন ভারত রাষ্ট্র নির্মাণে নেহেরু একক কলাকুশলী ছিলেন না।এটি ছিলো একটি বহুরৈখিক বহুমাত্রিক ও বহুধা রাজনৈতিক ক্যারিকেচার। নেহেরুবাদকে জ্যাকেরিয়া ব্যাখ্যা করেন এভাবে- ‘ নেহেরুবাদ বলতে যা বোঝায় তা একরকমের সমঝোতা যা নেহেরুর নামে চলে এসেছে।এই সমঝোতার উদ্দেশ্য ছিলো রাজনীতির পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে কোনো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ভারতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে না নিতে পারে।অতএব বলা যায় যে নেহেরুবাদ হলো রাজনীতির সেই ভাষা যা কতগুলি বিষয়কে বৈধতা দিয়েছিলো,তেমনি অন্য কতগুলি বিষয়কে বৈধতার পরিসরের বাইরে রেখেছিলো।
পরিমল ঘোষের ” আমাদের আধুনিকতার কয়েকটি দিক” প্রকাশ করেছে সেতু প্রকাশনী।প্রচ্ছদ এঁকেছেন দিলীপ ঘোষ।বইটি সংগ্রহে রাখা জরুরি মনে করি।
ফম/এমএমএ/