কবি মারিয়া তুষার-এর জিয়ন্ত জাগৃতী  

যুবক অনার্য ।। মারিয়া তুষার।কবিতা লিখছেন প্রায় ১ দশক। ১ দশক ধরে লিখে যাওয়া এক নাতিদীর্ঘ অধ্যায় – বলা যেতে পারে। নিরলস এই কাব্যকৃতির পর আলোচ্যমান কবির লেখা-বিষয়ক সমীকরণটি কেমন- প্রশ্ন করা স্বাভাবিক বৈকি।
উদ্দিষ্ট সেই সমীকরণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ক্রনোলজিক্যালি একটু পেছন থেকে শুরু করছি।-
কবিতা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে বিগত তিনহাজার বছরের ইতিহাস বলছে- ” কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এ যাবৎ রয়ে গেছে অনির্ণীত।”  সংগত কারণেই দ্বিতীয় প্রশ্ন – কবিতা আগে নাকি গান কবিতার আগে সৃষ্টি হয়েছিলো।
ছবি আঁকা নিয়ে গবেষণায় যেমন দেখা গেছে – গুহা চিত্রসমূহই ছবির বা চিত্র শিল্পের আদি নিদর্শন, ঠিক নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ছেনেও দেখা যাচ্ছে – কবিতার আগেই গানের ব্যুৎপত্তি। গান- এর কথা এজন্যই যে, গান একটি সর্বসাধারণ ও সর্বজনমন্ডিত শিল্প। কিন্তু কবিতা সর্বজনীন শিল্প নয়। তাই গানের ইতিহাস আদি হলেও এর বিবর্তনধারা জটিল, সঘন,  ত্বরিত ও বহুধা পর্বান্তরিত নয়। কবিতা- যেহেতু – শিল্পসৃষ্টি ও শিল্পানুরাগী একটি বিশেষ শ্রেণির চর্চিত অধ্যায়, স্বভাবতই এর বিবর্তনধারা জটিল ও বহুধা বিস্তৃত।
কিন্তু কেনো? এজন্যই যে, কবিতা মানবসভ্যতার বিকাশের ধারাকে চিত্রিত করে। গান যে করে না,তা নয় কিন্তু কবিতার ভূমিকা গানের চেয়ে এক্ষেত্রে অধিকতর  ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক।
তো,কবিতার ভূমিকা ও বিবর্তনধারা এগিয়েছে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পরিবার সমাজ রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রিক সম্পর্ক বিরোধ ও অভিযোজনার মধ্য দিয়ে; আর এ কারণেই কবিতার আন্ত অভিযোজন ও বহিঃঅভিযোজন থেকে গেছে একইভাবে দ্বান্দ্বিক  ও  অভিকর্ষীয় উৎপ্রেক্ষাময়।
কালের বিবর্তনে কবিতা তাই শুধু শব্দময় ভাষা সংকেতে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠেছে ভাষাতীত বোধের বিমুর্ত বয়ান। আমরা পেলাম ক্লাসিক নিও- ক্লাসিক  রোমান্টিক পর্ব পেরিয়ে কবিতার  আধুনিক পর্ব। কবিতায় এই ” আধুনিকতাবাদ” – কে কোনো একক অভিধায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। নানা ইজমের এক বিশ্লিষ্ট সংবেদই – আধুনিকতাবাদ।
বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ সুধীন দত্ত বুদ্ধদেব বসু  অমিয় চক্রবর্তী বিষ্ণু দে থেকে শুরু হয়ে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও কবিতায় আমরা দেখতে পাই সেই আধুনিকতাবাদের টানাপোড়েন সর্বোপরি আধুনিক জঙ্গম।কবি মারিয়া তুষারও এর ব্যতিক্রম নন।প্রথম দশকের পর দ্বিতীয় দশকে কবিতা নিয়ে যে নিরীক্ষা পর্বের সূচনাকাল, মারিয়া তুষার সেই পর্বের সম্ভাবনাময় এক কবিতাকর্মী।
মারিয়া তার কাব্য ‘জাগতিক’ – এ থাকতে চেয়েছেন সাম্প্রতিক ও সর্বসাম্প্রতিক অভিযোজনার কলেবরে এক অতি প্লাবিত ও সংশ্লিষ্ট অভিব্যঞ্জনার ঘাত ও প্রতিঘাতে।তাই তিনি কবিতায় উল্লেখ করেন স্পর্ধিত কণ্ঠস্বরে:
রাজপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা,
নবীন কিশোরের রক্তের দাগ!
আমি চাই,
এক অচেনা হাওয়া আসুক!
এ দেশের মানুষ,
আবার নতুন স্বপ্নে ভাসুক!
কিন্তু কবিতা তো কেবলি সাম্প্রতিকতার অনুধ্যানেই অভিষিক্ত নয়,বরং তা জাগতিক ও মহাজাগতিক বা কজমিক দ্যোতনারও অভিসারী।যেমন-
ওহ্ আমার-
‘বিদ্বেষী প্রাণ-খোলা হাসি’
বিলাপেরও রঙ বদলায়।
শোকের গানও সুর বদলায়।
ঝড়-ঝাপটা; ঘূর্ণিঝড় শেষে,
পৃথিবী আবারও হাসে,
নতুন ফুলের সুবাসে।
অথচ, তুমি রয়ে যাও।
……..তুমি রয়ে যাও
তবু,যিনি মারিয়া,যিনি কবি,পুনরায় যেনো দেখতে পান এবং দেখিয়ে দিতে চান- পায়রা উড়ানো এ শহর যেনো কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় অবরুদ্ধ হয়ে আছে সহিংস বেড়াজালে:
কবে রোদ্দুর চুমু খাবে,
কপোলে ওদের!
অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে,
….স্বপ্ন সবার!
এ শহর জুড়ে শুধুই,
লাশের আবাদ!
এবং স্বভাবতই কবি পীড়িত বোধ করেন মমতাময়ী স্বদেশ নিয়ে তার।কেননা চাদ্দিক ছড়িয়ে এক আলুলায়িত অন্ধকার আর নিবিড় অনিশ্চয়তা। কবি অনির্ণীত সময়কে দাঁড় করিয়ে দেন এক নির্ণীত দুঃসময়ের মুখোমুখি :
এই আমার দেশ?
তবুও মুখ ফেরাতে পারি না।
…ভালোবাসি যে অফুরন্ত!
কবি মারিয়া তুষার -এর কবিতার বিশেষত্ব তাঁর অনন্য ভাষাশৈলী, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা, এবং গভীর জীবনবোধে ফুটে ওঠে। তাঁর কবিতাগুলোতে প্রেম, বিরহ, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও অস্তিত্বের প্রশ্নগুলো তুলে ধরা হয়।
মারিয়ার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য:
১. দার্শনিক গভীরতা – তাঁর কবিতাগুলোতে জীবন, মৃত্যু, প্রেম এবং সময়ের প্রবাহ নিয়ে গভীর চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়।
২. প্রেম ও বিরহের সংবেদনশীল উপস্থাপনা – প্রেম তাঁর লেখায় শুধু রোমান্স নয়, বরং তা এক বিস্তৃত মানসিক ও দার্শনিক অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম।
৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা – সমাজের অসঙ্গতি, শোষণ, বৈষম্য এবং বিদ্রোহের প্রতিফলন তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
৪. আধুনিকতা ও বাস্তবতার মিশ্রণ – তাঁর কবিতাগুলো একদিকে নাগরিক জীবনের বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলে, অন্যদিকে বিমূর্ততা ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে।
৫. স্বাধীন ভাবনা ও অননুকরণীয় ভাষাশৈলী – সহজ-সাবলীল ভাষার সঙ্গে গূঢ় ভাবনার মিশ্রণে তাঁর কবিতা পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করে।
মারিয়া তুষার-এর কবিতাগুলো পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে, কারণ সেগুলো কেবলমাত্র ব্যক্তিগত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক ও দার্শনিক বাস্তবতার প্রতিফলনও বটে।
পরিশেষে বলতে চাই- কবি মারিয়া তুষার তার কাব্য ‘জাগতিক’-এ একটি গোটা দেশ ও জাতিকে দৃশ্যত রাখতে চেয়েছেন স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন আর জাগতিক সমুদয় জাগৃতীর মধ্য দিয়ে।শব্দ থেকে সশব্দে কবির এই অন্তর্ভেদী পরিভ্রমণকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কাব্য: জাগতিক
লেখক: মারিয়া তুষার
প্রকাশক: অমর্ত্য আতিক
চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ স্টল ৩৬৩/৩৬৪