কথিত অফিস সহায়ক সেলিমের সম্পদের পাহাড়

চাঁদপুর স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-৩

চাঁদপুর: চাঁদপুরে স্বাস্থ্য খাতে বেপরোয়া দুর্নীতি আর অনিয়মের মধ্য দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন কতিথ অফিস সহায়ক সেলিম। তার অবৈধ সম্পত্তি অর্জন যেন আলাদিনের চেরাগ পওয়ার মতো। কতিপয় বিপথগামী রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে সিভিল সার্জন অফিসের কর্মচারিদের মধ্যে কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন বিশাল দুর্নীতির সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের বাহিরে কিছুই করার ছিল না জেলার স্বাস্থ্য খাতে গত দেড় দশক।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, স্বাস্থ্যখাতে নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন কিংবা কোথায় হবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান সব নিয়ন্ত্রণ হতো ঐ সিন্ডিকেটের ইশারায়। আর চাঁদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এই সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড হলেন কথিত অফিস সহায়ক মো. সেলিম হোসেন। তার রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা ছিলেন, সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনির বড় ভাই জে আর ওয়াদুদ টিপু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম রোমান, উপজেলা চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী ব্যাপারী, পৌর মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল ও পৌর কর্মচারী শাহজাহান মাঝিসহ আরো কয়েকজন।

জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটটির ইশারায় চলতো জেলার পুরো স্বাস্থ্যখাত। তাদের আদেশ কিংবা নিষেধের বাহিরে কিছুই হতো না। তাদের ইশারায় চলতে নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য কিংবা রাজনৈতিক ট্যাগের খেলা। যা নিয়ে এ জেলায় কর্মরত চিকিৎসকরা থাকতো হতো সব সময় বিব্রত। শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের পদায়নের চাহিদা মাফিক অর্থ না পেলে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে করা হতো বদলি। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোনো ডাক্তার কোথায় ডিউটি করবে তা নির্ধারণ করে দিতো চিহ্নিত স্বাচিপ নেতারা।

এছাড়া শহরে কিংবা উপজেলায় প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন হতো সিন্ডিকেটটির ইশারায়। নতুন কোন হাসপাতাল অনুমোদন নেয়ার ক্ষেত্রে সেলিম সিন্ডিকেটের চাহিদা থাকতো নূন্যতম ৩লাখ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ক্ষেত্রে চাহিদা ছিলো ২লাখ টাকা। তাদের এই চাহিদা পুরন না হলে অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে শুরু হতো টালবাহানা। আর বাৎসরিক লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে নেয়া হত নূন্যতম ১০ থেকে ৫০হাজার টাকা। এসব তথ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুক্তভোগী মালিক পক্ষের অনেকেই।

এই চক্রকে প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা মাফিক অর্থের জোগান না দিলে করা হতো ভ্রাম্যান অভিযানসহ মোটা অঙ্কের জরিমানার খেলা। যার কারণে অনুমোদন কিংবা বার্ষিক নবায়নসহ সব ক্ষেত্রেই এই সিন্ডিকেটের চাহিদা মাফিক টাকা দিতে হতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে। অবৈধ এই অর্থ কালেকশনের ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে ছিল সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কথিত অফিস সহায়ক মো. সেলিম হোসেন।
হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী একজন হাসপাতাল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০২৩ সালে একটি নতুন হাসপাতাল খোলার জন্য আবেদন করা হয়। ওই সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সেলিম ২লাখ টাকা দাবী করেন। তার এই দাবীকৃত টাকা না দিয়ে খামে করে ৭হাজার টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু সেলিম ক্ষিপ্ত হয়ে ওই খাম ছুড়ে পেলে দিয়ে বলে কী দিলেন, আপনার কাজ হবে না। এভাবে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত কালক্ষেপন করে সেলিম চক্র। ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে কয়েকদিনের মাথায় হাসপাতালটি অনুমোদন পায়।
প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে সেলিম চক্রের খপ্পরে পড়েন আরেক ব্যয় বহুল হাসপাতালের মালিক পক্ষ। তারা সেলিমের নানামূূখী জটিলতা তৈরী করে তাদের কাছ থেকে আদায় করেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

এভাবেই চাঁদপুর জেলার প্রায় দুই শতাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনুমোদন, নবায়ন ও নানা জটিলতা তৈরী করে বিপুল পরিমান টাকার মালিক হন কতিথ অফিস সহায় সেলিম। এসব অবৈধ অর্থ দিয়ে সেলিম নামে ও বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদ।

অভিযোগ আছে, গত দেড় দশকে জেলার সর্বত্র যেখানেই প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার অনুমোদন করে সবখানেই কমিশনের ভাগ নিয়েছে সেলিম। আর তার আশ্রয়দাতা নেতাদের কর্মীরা বিনা পুঁজিতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ থেকে ২৫ শতাংশ শেয়ার কিংবা মালিকানা পেত। তবে এসব বিষয়ে গুলো থাকত অদৃশ্য। এমন কাণ্ডের মাধ্যমে সেলিম হয়ে গেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক।
সেলিমের যত সম্পদ ॥ কথিত সেলিম চাঁদপুর শহরে করেছেন একাধিক বাড়ি, ক্রয় করেছেন প্লট, হয়েছেন বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অংশীদার। দুর্নীতিবাজ সেলিমের সিন্ডিকেটের একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় চাঁদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বহাল তবিয়তে থাকায় শহরের প্রফেসরপাড়ায় ‘উম্মে ভিলা’ হোল্ডিং নং-৫৯৯, শহরের নাজিরপাড়ায় ৮৫১নং (৩শতায়ংশ জমির দলিল দেখিয়েছেন মেঝ ভাই ও ভগ্নিপতির নামে) হোল্ডিংয়ের ৫ তলা বাড়ির মালিক বনে গেছেন। এছাড়া ফরিদগঞ্জ উপজেলার চররামপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে পাকা দালান, শহরে ক্রয় করেছেন নামে বেনামে আরো একাধিক প্লট। একাধিক ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা এফডিআর।

অনুসন্ধান, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে জানাগেছে, প্রফের পাড়ার ‘উম্মে ভিলা’ হোল্ডিং নং-৫৯৯। এটি সেলিমের নিজ নামে এবং তিনি নিজেই পৌর কর পরিশোধ করে আসছেন। এক্ষেত্রে তিনি জালিয়াতের আশ্রয় নিয়েছেন। ওই ৫ তলা ভবনের মূল্যমান ১০হাজার টাকা দেখিয়ে বাৎসরিক কর পরিশোধ করে আসছে ২ হাজার ৩০০টাকা।

এছাড়া তার নাজির পাড়ায় ৮৫১নং (৩শতায়ংশ জমির দলিল দেখিয়েছেন মেঝ ভাই ও ভগ্নিপতির নামে) হোল্ডিংয়ের ৫ তলা বাড়ির মালিক বনে গেছেন। তবে এখানে তিনি কৌশলে নিজের নাম ব্যবহার করেননি। কিন্তু পৌরসভায় এসব কাগজপত্রে তার ব্যাক্তিগত মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে সেখানে করদাতার নাম লিখেন আলী আহমেদ গং। এখানেও এই ভবনের মূল্যমান ১ হাজার ৭০০টাকা দেখিয়ে বাৎসরিক কর দিচ্ছেন ৩৯১টাকা। এই বাড়ির জমির মালিকানা দেখিয়েছেন ফরিদগঞ্জ উপজেলার কালির বাজার এলাকার চরপাড়া গ্রামের কড়ি বেপারী বাাড়ির ছেলামত উল্যার ছেলে আলী আহমেদ এবং একই উপজেলার রামপুর বাজার এলাকার মাষ্টার বাড়ির হাসিম মিয়ার ছেলে কালু। কিন্তু নাম জারিতে ব্যবহার হয় সেলিমের ব্যবহৃত ০১৭১৫………..১৪১নম্বর। আর আলী আহমেদ এর খারিজে ব্যবহার করেন ভূয়া নম্বর। ওই নম্বরে চাঁদপুর শহেরর এক তরুন ব্যবসায়ীর খুঁজ মিলে। তিনি এই আলীহ আহমেদ ও কথিত সেলিম নামের কাউকে চিনেন না বলে জানান।

এছাড়াও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানাগেছে কথিত অফিস সহায়ক সেলিমের আরো অনেক সম্পদ রয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চলছে।

এমন সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. সেলিম হোসেন দাবি করেন সব কিছুই মিথ্যা অভিযোগ। এমনকি সিন্ডিকেট বা রাজনৈতিক নেতাদের তিনি চিনেন না। তবে পৌর কর্মচারী শাহজাহান মাঝি তার বন্ধু। (ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে চলমান থাকবে…)

ফম/এমএমএ/

মুসাদ্দেক আল-আকিব | ফোকাস মোহনা.কম