
।। এস ডি সুব্রত।। শেষ কার্তিকে নতুন ফসল ঘরে তুলতে নানা উৎসবের মাধ্যমে দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে পালিত হলো গারো সম্প্রদায়ের ওয়ানগালা উৎসব বা গারো নবান্ন উৎসব।
আসছে বছরে যেন ফসল ভালো হয়, সন্তান ও পরিজনরা যেন ভালো থাকে আর দেশের যেন মঙ্গল হয়- এই কামনায় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ‘গারো’ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব এ ওয়ানগালা অনুষ্ঠান পালিত হয়।দিনটি উদযাপন উপলক্ষে গারো সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা বিচিত্র পোশাক ও পাখির পালক মাথায় দিয়ে লম্বা ডিম্বাকৃতি ঢোলের তালে তালে নাচে। এটি গারোদের বছরের প্রধান বিনোদনের দিন। সারা গারো পাহাড় মন্ত্র ও ঢোলের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। এসময় মহিষের শিঙে বানানো এক ধরনের বিশেষ আদিম বাঁশির সুর সবাইকে বিমোহিত করে। ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। এদের বিশ্বাস, দেবতা মিসি সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদ্গম ও তার পরিপক্বতা ঘটায়। তাই ফসল গ্রহণের আগে তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় এ উৎসবে। একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলা হয়ে থাকে। এটি গারো মান্দিদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
তাদের বিশ্বাস, দেবতা সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদগম ও তার পরিপক্বতা ঘটায়। তাই ফসল গ্রহণের আগে তারা তার পূজা করে থাকে।প্রথমেই মোরগ উৎসর্গ করে মিসি সালজং বা সূর্যদেবতার নামে। তারপর বাড়ি বাড়ি চলে নতুন ধানের চাল দিয়ে ‘চু’ বা মদ তৈরির প্রস্তুতি। সংনি নকমা অর্থাৎ গ্রামপ্রধান সভা ডেকে ওয়ানগালার দিন ঠিক করে জানিয়ে দেন সবাইকে। শুরু হয় পূজার স্থান, বাড়িঘর, গোলাঘর মেরামত ও পরিষ্কার করে নেওয়া। পরিবারের জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক। উৎসবের জন্য সংগ্রহ করা হয় মোরগ ও ডুকুয়া পাখির পালক। উৎসবের প্রথম দিনের নাম ‘রুগালা’। এ দিনটিতে শস্যের জননী ও ভাণ্ডার দেবী রক্ষিমে, গৃহদেবতা, সূর্যদেবতা প্রভৃতির উদ্দেশে মদসহ উৎসর্গ করা হয় নতুন ধানের ভাত, নতুন ফসলের ফলমূল, শাকসবজি ও পশুপাখি। গৃহদেবতার উদ্দেশে নকমা মদ ও পানীয় উৎসর্গ করে একইভাবে মুরগির রক্ত ও লোম লাগিয়ে দেন বাদ্যযন্ত্র গুলোতে। তারপর কলার পাতায় ঢেকে রাখা কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর মন্ত্র পড়ে মদ উৎসর্গ করে শুরু হয় ওয়ানগালার প্রধান পূজা-অর্চনা।
এরপর নকমা সূর্যদেবতাকে উদ্দেশ করে মন্ত্র পড়ে মদ উৎসর্গ করেন এবং পাশে রাখা মিল্লাম (তরবারি) ও স্পি (ঢাল) হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করেন। সবাই এসময় বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাতে থাকে। রুগালার রাতে গারোরা নাচ-গান, আমোদ-প্রমোদ করে কাটায়। প্রত্যেক বাড়িতে তৈরি হয় পিঠা। যুবক-যুবতীরা খুশি মনে নেচে গেয়ে পরস্পরকে মদ পান করায়। এভাবে প্রতিটি বাড়িতেই ‘রুগালা’ সম্পন্ন করতে হয়।ওয়ানগালার দ্বিতীয় দিনটিকে বলে ‘সাসাত সআ’। মানে ধুপ উৎসর্গ অনুষ্ঠান। ওইদিন নকমা তার সারা ঘরে নতুন চালের ভাত ছিটিয়ে দেন।
উৎসবের তৃতীয় দিনটিকে বলে ‘ক্রাম গগাতা’। অর্থ নকমার ক্রাম নকমার ঘরে তোলা। ওইদিন সকাল থেকে প্রথমে নকমার ও পরে সবার বাড়িতেই সংক্ষিপ্ত আকারে পালন করা হয় রুগালা ও সাসাত স’আর আচারগুলো। সন্ধ্যার আগে বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে সবাই সমবেত হয় নকমার বাড়িতে। তিনি তখন সবাইকে শেষ বারের মতো তা বাজাতে বলেন। দামা, ক্রাম, রাং প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রগুলো তখন নকমার ঘরেই জমা রাখা হয়। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে মান্দি বা গরোদের ওয়ানগালা উৎসবের।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
subratadassulla@gmail.com